সবকিছু বৃথা গেলেও দোআ বৃথা যায় না
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ ، ثُمَّ قَرَأَ هَذِهِ الْآيَةَ : { ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ ، إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ [غافر]} سنن الترمذي
নুমান ইবনে বশীর رضي الله عنه বর্ণনা করেন যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন (অর্থ): দোআ হল ইবাদত। তারপর তিনি কুরআন মাজীদের এ আয়াতটি পাঠ করলেন (যার অর্থ): আমাকে ডাকো (অর্থাৎ, আমার কাছে চাও) আমি তোমার আহবানে সাড়া দেব। যারা আমার ইবাদতকে অহংকারবশত অবজ্ঞা করে [অর্থাৎ আমাকে ডাকবে না আর আমার একত্ববাদে বিশ্বাস করবে না] তারা অবশ্যই অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে [সূরা মুমিন (বা সূরা গাফির: ৬০)]। তিরমিযী
বোঝা গেল, দোআ স্বয়ং ইবাদত। অন্য হাদীসে আছে (অর্থ): দোআ ইবাদতের সারবস্তু বা মূল।
সব অবস্থায় আল্লাহ তাআলার কাছে দোআ করা জরুরি। বান্দা বিপদাপদ, অসুবিধা, কষ্টে, অসুস্থতা বা যেকোনো প্রতিকূলতায় দোআ করুক — সেটি উপকারি। অনুকূল অবস্থায়, যখন বড় কোনো বালা-মসিবত নেই, তখনও দোআ করা জরুরি, আর সুন্নত হল, সব অবস্থায় দোআ করতে হবে। কেউ যদি মনে করে, আমার কোনো বিশেষ অসুবিধা নেই, বড় কোনো সমস্যা নেই, অসুখ নেই, আমি কোনো ঋণে পড়িনি, আমার টাকা-পয়সারও অভাব নেই, আমি কেন দোআ করব? এ কথাটি কতই না মূর্খজনিত!
আমরা প্রত্যেকে প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলার মুখাপেক্ষী। আমাদের ওপর তাঁর দান-অবদান কখনো শেষ হয়নি! বরং কেবলই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা পার্থিব জীবনে আগমনের আগে থেকেই তিনি রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন। আজ পর্যন্ত কত শত গুনাহে নিমজ্জিত থেকেও আমরা কেবল তাঁর জগতের নাজ-নেয়ামত ভোগ করে যাচ্ছি! কোনো ঈমানদার এগুলো অস্বীকার করতে পারে না। তাহলে কী পরিমাণ শোকর আদায় করা দরকার? এখন ভালো আছি বা এখন সঠিক পথে আছি অর্থ এটা নয় যে, কালও ভালো থাকব বা কালও আমি সঠিক পথে থাকতে পারব। অতএব, আশা ও ভয় নিয়ে আল্লাহ তাআলার কাছে দোআ করা ছাড়া আমাদের কী অন্য কোনো উপায় রয়েছে? বাস্তবিকই, অন্য কোনো উপায় নেই।
যত জায়েয উপায় ও অবলম্বন আমরা ব্যবহার করছি সেগুলো ব্যবহার করতে হবে, সঙ্গে অবশ্যই দোআ করতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে চেষ্টার পথ খোলা আছে সেসব ক্ষেত্রে, চেষ্টার পাশাপাশি দোআ যদি অনবরত করা হয় তার ফলাফল আর (সেসব ক্ষেত্রে) কেবল চেষ্টা করে দোআ না করার ফলাফল কী এক? প্রথমটি একজন উন্নত ঈমানদারের গুণ, দ্বিতীয়টি কি একজন উন্নত ঈমানদারের কর্মপন্থা? একটু চিন্তা করলে সত্যটি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
কেবল বিপদে পড়লেই যদি আল্লাহ তাআলাকে আমার স্মরণ হয়, তাহলে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে আমার সম্পর্কটি কেমন, সেটি যেকোনো বুদ্ধিমানই বোঝে।
উপলব্ধি বিলম্বে আসলেও পরিবর্তনের পদক্ষেপে বিলম্ব নয়
যদি এমন হয় যে, আমি উপরে উল্লেখিত ব্যক্তির ন্যায়। অনুকূল অবস্থায় আমার নামায আর আল্লাহকে স্মরণে অনেক ঘাটতি হয়ে থাকে। কর্মব্যস্ততা আর আমদানী বৃদ্ধির আগ্রহতে বিভোর হয়ে আমি আল্লাহকে ভুলে যাই, তাহলে এখনই তওবা-ইস্তেগফার করে নেওয়া জরুরি।
উন্নত ঈমানদারেরা নফল নামায, সালাতুল হাজত, সালাতুত তাওবা সব অবস্থায় পড়েন। তাদের এ কথা জানা আছে যে, আমার ফরয নামাযে ভুল হয়েই থাকে, আল্লাহ তাআলার কাছে আমি সব ‘হাজত’ বা প্রয়োজনের ব্যাপারেই সর্বক্ষণ মুখাপেক্ষী, গুনাহ আমার দ্বারা হতেই থাকে — সবসময় আমি বুঝি না যে গুনাহ হচ্ছে। অতএব এই উপলব্ধি তাদের জাগতিক সব কাজের পাশাপাশি আল্লাহর স্মরণ তাজা রাখছে। বরং, কখনো অনুকূল অবস্থায় দোআ হ্রাস পেলে ও আমলে ত্রুটি হলে ভীত হয়ে যাচ্ছেন তারা!
আমার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার সম্পর্ক মজবুত হয়নি, আমি কেবল বিপদে পড়লেই আল্লাহকে ডাকি — এর অর্থ এ নয় যে, আমার পথ বন্ধ! আলহামদুলিল্লাহ, আমি তো ঈমানদার! আমি অন্তত বিশ্বাস করি যে আমার মালিক সব অবস্থায় একজন — আল্লাহ, তাঁর দান অবদানই আমি ভোগ করি, তাঁর কাছেই আমাকে সবসময় সাহায্য চাইতে হবে, উপায় নেই। অতএব, আমি নিজেকে সংশোধন করতে পারি। আল্লাহ তাআলার পথে আমি এগিয়ে যেতে পারি। উন্নত ঈমানদারদের জীবন ও নিজের জীবন তুলনা করে যদি আল্লাহ তাআলার পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য আমি চেষ্টার পাশাপাশি দোআ, শোকর ও ইস্তেগফার বৃদ্ধি করি, ইনশাআল্লাহ এগুলোর বরকত আমি নিজ জীবনেই দেখতে পাব!
আসুন আজ থেকেই এমন কাজটিকে (আল্লাহর কাছে দোআ চাওয়া) আর অবহেলা না করি যেটি কখনো বৃথা যায় না। যেটি অশেষ-অসীম এক সম্পদ — দুনিয়ার জীবনেও উপকারি, মৃত্যুর পরও উপকারি!
এ লক্ষ কখনো ভ্রষ্ট হয় না
এ তীর কখনো বৃথা যায় না,
আমাকেও তুমি দাও হে মাওলা
চাওয়ার তাওফীক
তোমার কাছে আল্লাহ!
(আমিন)
কে কার জন্য দোআ করবে ও প্রাসঙ্গিক আরো কিছু বিষয়
নিজের যাবতীয় প্রয়োজন ও বিপদ দূরের জন্য নিজে দোআ করা অতীব জরুরি! হাঁ তারপরই ঘনিষ্ঠজনদের কাছে নিজের জন্য আমরা দোআ চাব (আমাদেরও উচিত নিজের জন্য দোআ করার সময় ঘনিষ্ঠদের জন্য দোআ করা)। সঙ্গে, আল্লাহওয়ালাগণের কাছে দোআ চাওয়াটি বিশেষ বরকতের কারণ! অনেক সময় দীর্ঘদিন নিজে দোআ করি কিন্তু কোনো ফল দেখি না। এর অর্থ এ নয় যে দোআ কবুল হচ্ছে না, দোআ করে যেতেই হবে। এ ব্যাপারে হাকীমুল উম্মত থানভী রাহিমাহুল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করেছেন: আমরা যেন দোআ করে তার সরাসরি ফলকেই দোআ কবুলের মূল বা উদ্দেশ্য মনে না করি। দোআ করেছি, আল্লাহ তাআলার রহমত দোআ করার সঙ্গে সঙ্গেই বান্দা প্রাপ্ত হয়েছে। এটিই দোআ কবুলের মূল অর্জন। তারপর কিভাবে কখন দোআর প্রভাব আমরা দেখব সেটি দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়। কত সুন্দরই না বলেছেন উলামায়েকেরাম — আরে আল্লাহর কাছে চাইতেই থাকো। তাঁর না দেওয়াও তো দেওয়া! কিছু দিলেই কি সব লাভ হয়ে যায়? কীসে আমার ভালো, আর কীসে মন্দ সেটা আল্লাহ ভালো জানেন, নাকি আমি? উদাহরণস্বরূপ, কেউ মরণব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে এখন কাঁদছে, দোআ করছে যেন আল্লাহ তাকে সুস্থতা দান করেন, হায়াত দান করেন। এ দোআ তো করতেই হবে, তাই করাও হল। সে নিজেও দোআ করল, সঙ্গে তার আত্মীয়-স্বজন সবাই দোআ করল। কিন্তু দোআটি বাহ্যত কবুল হল না। সে ঐ রোগেই মৃত্যুবরণ করল। এখন কে জানে সে বেচারা জীবিত থাকলে কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হত? হয়ত এমন কোনো ফেতনা (পরীক্ষা) তার ওপর আসতে পারত যা কিনা তার ঈমানের মতন অমূল্য সম্পদই ছিনিয়ে নিত! কিন্তু সে আগে ইন্তেকাল করল, ঈমান নিয়ে ইন্তেকাল করল।* কখনো তো অনেক বিষয়ের ভালো-মন্দ আল্লাহ তাআলা দেখিয়েই দেন। আমরা চিন্তা করি না। তাই বাহ্যিক ফলাফল দেখার জন্য দোআ করা এক বোকামি ছাড়া কিছু নয়। আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্তে খুশি থাকা অনেক বড় গুণ। এ বিষয়ে আমাদের সাইটে কিছু প্রবন্ধ রয়েছে। সেখানে দ্রষ্টব্য, যেমন:
যে কথাটি বলা হচ্ছিল, নিজে নিজের জন্য দোআর সঙ্গে যদি আল্লাহ পাকের কোনো নেক বান্দাকে নিজের প্রয়োজনটি জানিয়ে দোআ চাওয়া হয় তা অনেক বড় ভুমিকা রাখে! প্রয়োজন ও বিপদের সময় আল্লাহর নেক বান্দারা পর্যন্ত নিজের জন্য নিজে দোআর পাশাপাশি তাদের মুরুব্বি ও আলেম-উলামা-আল্লাহওয়ালাদের কাছে (নিজের ঐ প্রয়োজন ও বিপদ উল্লেখ করে) দোআ চান। অভিজ্ঞতা বলে, এতে দ্রুত সুফল পাওয়া যায়।
———————————————————————
*এক্ষেত্রে একটি বিষয় চিন্তা করুন! যা শুধু বাস্তবই নয়, অনেকে এমন চিত্র আশেপাশে কারো জীবনে দেখেও থাকবেন হয়ত! কেউ এমন কোনো বিপদে পড়েছে যে, তার কাছে এখন মৃত্যুই শ্রেয় মনে হচ্ছে। সে হয়ত বলে বসছে, হায়! এর থেকে আমার মৃত্যু চলে আসুক। কিন্তু মৃত্যু কামনা করা তো নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন ক্ষেত্রেও আমাদেরকে দোআ শিখিয়েছেন, জানিয়েছেন যেন আমরা যেন এভাবে দোআ করি:
اللَّهُمَّ أَحْيِنِي مَا كَانَتِ الْحَيَاةُ خَيْرًا لِي، وَتَوَفَّنِي إِذَا كَانَتِ الْوَفَاةُ خَيْرًا لِي
বরকত হিসেবে হাদীসের অর্থটি দেওয়া হল (যেখানে দোআর অর্থটিও রয়েছে):
তোমাদের কেউ যেন কোনো বিপদে পড়ার দরুণ মৃত্যু কামনা না করে। কিন্তু এমন মনে হয় (যে এর থেকে তো মৃত্যু শ্রেয়) তাহলে যেন এভাবে দোআ করে: হে আল্লাহ! আমাকে তত সময় জীবিত রাখুন যত সময় আমার জন্য কল্যাণকর। আর যখন আমার জন্য মৃত্যু কল্যাণকর তখন আমাকে মৃত্যু দান করুন। বুখারী
Last Updated on October 1, 2023 @ 7:20 pm by IslamInLife বাংলা