কে প্রকৃত দুনিয়াত্যাগী আর কে দুনিয়া-অন্বেষী
অধিকাংশ মানুষ মনে করে যে দুনিয়াত্যাগী মানে সংসারত্যাগী। সংসারের কাজে যার মনোযোগ খুব কম বা একেবারে নেই। ধর্মকর্মে ব্যস্ত।
দুনিয়া করা বলতে আমরা পার্থিব কাজকর্ম বুঝি, টাকা-পয়সা রোজগার বুঝে থাকি। ইসলামে ‘দুনিয়া করা’ বলতে ‘কসবে হালাল’ তথা হালাল উপার্জন বোঝায়। এটিও ইবাদত, যদিও তা পরোক্ষ। আর দুনিয়াত্যাগী বলতে যদি সংসারত্যাগী হয়ে যাওয়া বোঝায়, ইসলাম সেটা সমর্থন করে না। এটা বাস্তবে সম্ভবও নয়। মানুষের সঙ্গে তার প্রয়োজন লেগেই আছে। ইবাদত করতে হলে সুস্থ থাকতে হবে, খাওয়া-পরা সুস্থতার জন্য অতীব প্রয়োজন। তাই দুনিয়াতে অবস্থান করে সম্পূর্ণ দুনিয়া ত্যাগ করে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করা কখনো সম্ভব নয়। তাই সম্পূর্ণ সংসার ত্যাগ করে ধর্মকর্ম করা ইসলাম সমর্থন করে না। এটা ইসলমের শিক্ষা নয়।
যদি দুনিয়াত্যাগী বলতে তাকে বোঝায় যে কিনা দুনিয়ার লোভ-লালসা থেকে মুক্ত হয়ে হালাল উপার্জনের ক্ষেত্রেও সীমারেখা মেনে চলে — আখেরাতকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্য শব্দটি ব্যবহার করা ঠিক হবে। যদিও হয়ত এরকম মানুষের সংখ্যা আজ কম।
হালাল উপার্জনে নিয়োজিত থাকা দুনিয়াবিরাগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ, শরিয়তে হালাল উপার্জন উদ্দেশ্য। যদি কেউ শরিয়তের বিধি-বিধান মেনে চলে প্রচুর হালাল উপার্জন করে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, জাগতিক লোভ-লালসা থেকে সে অন্তরকে মুক্ত রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকে; এটি তখনই সম্ভব যখন কোন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যাকাত এবং অন্যান্য হকসমূহ ঠিকঠাক আদায় করেন। এমন ব্যক্তিও এই হিসেবে দুনিয়াত্যাগী যে, তার এই আয়-উপার্জন আল্লাহ তাআলার পথে উপার্জিত ও ব্যয় হচ্ছে। মুমিন দুনিয়ার জন্য দুনিয়া করে না। মুমিন আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যই দুনিয়া করে থাকে। এ দুনিয়ার উদ্দেশ্য তাই দুনিয়া নয়, এতো দ্বীন।
মূল কথা হল, কেউ সাধ্যানুযায়ী হক-হালালভাবে দুনিয়া উপার্জনের চেষ্টায় রত হয়ে যত কম বা বেশি দুনিয়া অর্জন করুক, অন্তর দুনিয়ার লোভ ও লালসামুক্ত রাখতে হবে। কারণ, দুনিয়ার প্রতি লোভ সব অনিষ্টের মূল। দুনিয়ার প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও তাতে মন এমনভাবে লাগানো যে, নামায, রোযা, সত্য কথা, আচার ব্যবহার, অন্যের হক ইত্যাদির পরোয়া যা না করা হয় — এটাই দুনিয়ার সেই ক্ষতিকর দিক যা কিনা মানুষের দ্বীন ও দুনিয়ার হায়াতকে বরবাদ ও ধ্বংস করে দেয়।
মুমিন দুনিয়াকে রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাধ্যম বানাতে চেষ্টা করে থাকে। কারণ আল্লাহ তাআলার আদেশ এটিই। জগৎ-সংসারের যত কাজ আছে সেগুলো আল্লাহ তাআলা ও তাঁর প্রিয় রাসূল ﷺ-এর বিধান অনুযায়ী করতে হবে। তাহলে দুনিয়া তার জন্য রহমত হবে, দুনিয়ার কায়কারবার তার জন্য মাগফেরাত ও নাজাতের মাধ্যম হবে ইনশাআল্লাহ। এমন ব্যক্তিই প্রকৃত দুনিয়াত্যাগী; কারণ, তার আসল উদ্দেশ্য আখেরাত, মানে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন। দুনিয়ার যত নাজায়েয কাজ আছে সেগুলো চাই ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট হোক (যেমন বেদআত), আর চাই লেনদেন, আচার-ব্যবহারে সাথে সংশ্লিষ্ট হোক (যেসব বিষয়গুলি হারাম ও গর্হিত) সেগুলি ত্যাগ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য, এ গুণ অর্জনকারী মুমিনই দুনিয়াত্যাগী। প্রতিটি মুমিনেরই এ গুণটি সাধ্যানুযায়ী অর্জন করা উচিত।
একবার তিনজন যুবক রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর ঘরে এসে উম্মুল মুমিনীনগণকে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। যখন তাদের এর বিবরণ দেওয়া হল, তখন তারা নিজেদের আমলকে তুচ্ছ মনে করে বলাবলি করতে লাগল, আমাদের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কী তুলনা! মহান আল্লাহ তাঁর পূর্বাপর সব ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাদের একজন বলল, আমি সারা রাত জেগে ইবাদত করব। অন্যজন বলল, আমি আজীবন রোযা রাখব, কখনো ভাঙব না। আরেকজন বলল, চিরদিনের জন্য নারীদের থেকে দূরে থাকব, কখনো বিয়ে করব না। এ অবস্থায় রাসুলুল্লাহ ﷺ এসে তাদের বলেন (অর্থ),
তোমরাই কি এমন এমন কথা বলেছিলে? জেনে রেখো! আমি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয়কারী, তবু আমি রোযাও রাখি, ইফতারও করি, নামাযও পড়ি, ঘুমও যাই এবং আমি বিয়েও করি। অতএব, যে ব্যক্তি আমার সুন্নত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার দলভুক্ত নয়। বুখারি
উপরোক্ত হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রিয় নবীজি ﷺ থেকেই ইবাদত ও জাগতিক কাজ উভয়টি করাকে সুন্নত বলা হয়েছে।
এটা ঠিক যে দুনিয়াবিরাগী মুমিনদের মধ্যে বিভিন্ন রকম মানুষ রয়েছে। যেমন, কেউ হয়ত প্রচুর হালাল আয় বা আমদানী করতে পারে কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে করেন না; কারণ, তার কাছে মনে হয় যে, আমার এত প্রয়োজন নেই। সে তার আয়ের সীমার মধ্যেই সংশ্লিষ্ট অধীনস্থদের হক আদায় করে ফেলে। হয়ত তার সময়টিকে সে দ্বীনের ইলম অর্জন বা অন্য কোনো নেক কাজে ব্যয় করে থাকে। আবার কারো কাছে প্রচুর হালাল আয় বা আমদানী আছে এবং সে এ পথে চেষ্টা অব্যাহত রাখে। সে তার মালের যাকাতও প্রদান করে থাকে এবং অন্যান্যদের হক সঠিকভাবে দিয়ে দেয়। সে আরো অন্যান্য উপায়ে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতার চেষ্টা করে থাকে। এভাবে বিভিন্ন রকম মুমিন আছে, পাওয়া যাবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর সব বান্দাদের অবস্থা জানেন। তাই সাধারণভাবে আমরা খুব সহজে কারো সম্পর্কে সুনিশ্চিত আন্দাজ-অনুমান করতে পারব না যে, কে উত্তম কাজ করছে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে মুমিনদের মধ্যে পার্থক্য হয়, নিয়ত, তাকওয়া, নেক আমল সবই সমৃক্ত এতে।
পক্ষান্তরে দুনিয়াদার বা দুনিয়া-অন্বেষী ও দুনিয়া-অভিলাষী হল ঐ ব্যক্তি যার আসল উদ্দেশ্যই পার্থিব সম্পদ অথবা খ্যাতি ও যশ-ক্ষমতা অর্জন করা। এ করতে গিয়ে কোনটা আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন এ ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ বেখবর ও গাফেল। যেকোনো উপায়ে তার আমদানী-আয় বাড়লেই হল। হারাম নাকি হালাল এটা সে দেখে না। জুলুম নাকি এহসান এটা তার কাছে একদমই মূখ্য নয়। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য সে করে না, করলেও নিজ মন মতন করে থাকে। এমন বৈশিষ্ট্যধারী ব্যক্তি হল দুনিয়াদার, দুনিয়া-অন্বেষী ও দুনিয়া-অভিলাষী। হতে পারে অনেক দান-অনুদানে অভ্যস্ত, অনেক ইবাদতগুযার, অনেক নাম-ডাকওয়ালা ব্যক্তি, কিন্তু উদ্দেশ্য তার দুনিয়া আর দুনিয়ার পদ-পদবী কিংবা মাল। এমন মানুষের মধ্যে মুসলমান ও অমুসলমান উভয়ই থাকতে পারে। বাহ্যত মুসলমান হিসেবে বসবাস করছে এমন অনেক ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে মুনাফিকও হয়ে থাকে। মুমিন এমন হওয়া খুবই দুর্ভাগ্যজনক এবং তার ঈমান অবশ্যই শংকাপূর্ণ! কোনো কোনো আলেম অবশ্য মুমিনকে দুনিয়াদার বলতেই নারাজ; উনাদের বক্তব্য মুমিন দুনিয়াদার হতে পারে না। অবশ্য দুনিয়ার প্রতি লালায়িত এমন মানুষেরাও দুনিয়াদার সদৃশ এবং তাদের অবস্থা ভালো নয়। ঈমান সুরক্ষার জন্য দ্রুত তওবা করা জরুরি।
আবার, এমনও দুনিয়াত্যাগী থাকতে পারে যে, বাস্তবিকই দুনিয়ার মাল-দৌলত ও সম্পদে তার লোভ নেই। জগৎ-সংসারের খবর সে রাখে না। তার আমদানী-আয় খুবই কম, প্রয়োজন পরিমাণ, স্বল্প। কিন্তু আল্লাহ তাআলাকে সে স্বীকার করে না। এমন ব্যক্তি দুনিয়াত্যাগী হলেও সে তো ঈমানদারই নয়; সে কাফের।
Last Updated on March 14, 2023 @ 3:27 pm by IslamInLife বাংলা
লেখাটি খুব ই ভাল লাগলো।