আল্লাহ তাআলার দয়া থেকে চির বঞ্চিত কারা
কিছু প্রশ্ন আমাদের মনে উদয় হয়, জেগে ওঠে, যেগুলোর জবাব আমরা খুঁজি না। বা খুঁজলেও সেভাবে খোঁজা হয় না যেভাবে খোঁজা উচিত। আমরা সে বিষয়ে সেভাবে জেনে নিই না যেভাবে যতটুকু জানা জরুরি।
যেমন এমন প্রশ্ন বা ধারণা পোষণ (অথবা কোনো দ্ব্যর্থ চিন্তা): আচ্ছা আল্লাহ তো দয়াময়! তাহলে তো সবাইকে(ই) তিনি মাফ করে দেবেন!?
দেখুন, কথাটি শুনতে, বলতে, চিন্তা করতে খুব আনন্দ লাগে। অনেকের কাছে খুবই ভালো লাগে। তারা এটা ভেবে থাকে আর এমনই বলতে থাকে যেন তার মনের ভেতর কথাটি একটি স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। তখন এমন হয় যে, এ জাতীয় ধারণা ও বিশ্বাসপোষণকারীরা সব অন্যায় কাজ করার পরও বলে, “আল্লাহ দয়াময়, আমাকে মাফ করে দেবেন।” এ কথা এই বিশ্বাসপোষণকারীরা নিজেরা যেমন লালন করেন তেমন তারা অন্যদেরও বোঝান।
আল্লাহ তাআলা দয়াময় কথাটি কি সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য?
আল্লাহ তাআলা দয়াময়। এটি একটি কথা। তিনি মাফ করবেন — এটি আরেকটি কথা। তিনি সবাইকে(ই) মাফ করে দেবেন — এটি আরেকটি কথা।
প্রথম কথাটি সত্য। দ্বিতীয় কথাটিও সত্য। কিন্তু তৃতীয় কথাটি অসত্য এবং সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত একটা কথা।
‘আল্লাহ তাআলা দয়াময়’ এর ব্যাখ্যা হিসেবে কেউ যদি তৃতীয় কথাটি বলে সে প্রথম কথার একদম ভুল অর্থ বুঝেছে ও করেছে৷
সেই পবিত্র সত্ত্বা আল্লাহ তাআলা দয়াময়। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর দয়া সবার জন্য, তাও সত্য। তাই বলে যে কাজের জন্য শাস্তি বা যার জন্য শাস্তি উপযুক্ত হয়ে গেছে তাকেও তিনি দয়া করেন বা করবেন নাকি করবেন না — এর জবাবে ভুল ব্যাখ্যা করা যাবে না। একে তো অন্যায় করাই এক অন্যায়। আবার আল্লাহ তাআলার দয়া নামক সীফাত বা গুণের ভুল ব্যাখ্যা করে অন্যায় করা – এত আরও বড় অন্যায়!
যারা স্পষ্ট কাফের তারা কুফরীর উপর মৃত্যুবরণ করলে চির শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যায়। এমন ব্যক্তি দয়ার উপযুক্ত নয়। আল্লাহ তাআলার এরকম নাফরমান, বিদ্রোহী ব্যক্তিরা যে শাস্তির উপযুক্ত সে ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা তাঁর নীতি ও ফয়সালা সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। সেই শাস্তির ফয়সালা হয়ে গেলে তারা তাঁর দয়ার উপযুক্ত নয়। তাই কাফেররা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। যেক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা চির-শাস্তি ও অভিশাপ অবধারিত করেন, সেখানে কেউ দয়া প্রদশর্ন করতে পারে না। সেক্ষেত্রে আমাদের (ঐসব পাপাচারিদের প্রতি) দয়াপরবশ হওয়া বা দয়ার আশা করাটা সম্পূর্ণ বেমানান। বরং আল্লাহ তাআলার সাথে বেয়াদবি, সীমালঙ্ঘন ও সেটাও এক শাস্তির উপযুক্ত জঘন্য কাজ।
সেজন্যই, “সবাইকে(ই) আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেবেন” কথাটি একেবারেই অসত্য ও ইসলাম-বিরোধী। ইবলিস, নমরূদ, ফেরাউন, হামান, আবু জাহেলদেরকে ও তাদের অনুসারীদেরকে কোনো মুমিন কখনোই আল্লাহ তাআলার দয়ার উপযুক্ত মনে করে না। এটা অসম্ভব। তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদের জন্য চির-শাস্তি অবধারিত হয়ে গেছে।
আল্লাহ তাআলার চির দয়া ও ক্ষমার ঘোষণা কাদের জন্য
আল্লাহ তাআলার চির দয়া ও ক্ষমার ঘোষণা ও আচরণ হল ঈমান ও নেক আমলের সঙ্গে। যারা একদমই ঈমান ও নেক আমলের বিপরীত পথে হাটে, বিপরীত পথের সঙ্গীদেরকে সাথী-বন্ধু বানায়, তারা ঐ বিপরীত পথের পথিকই হয়ে থাকে। তাদের পরিণতি ঐরকম সর্বনাশাই হয়ে থাকে ঠিক যেমনটা তাদের বন্ধুদের হয়েছে/হয়ে থাকে/হবে।
আমরা যেন কখনো এমন ব্যক্তি ও তাদের পরিণতি দেখে কোনোভাবে দয়া না করি যারা আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের অভিশাপ বহন করে। আর তাদের নিকৃষ্ট পরিণতিতে বিলাপ বা দুঃখ করার তো প্রশ্নই ওঠে না!
শোক-দুঃখ আল্লাহ তাআলার আমরণ নাফরমানকারীর জন্য নয়
যে আগুন নিয়ে খেলে সে আগুনে পুড়ে মরবে। তার জন্য দুঃখ নয়। সুস্থ মস্তিষ্কে আগুন নিয়ে খেলাকারীর জন্য মায়া নয়। যে কিনা আজীবন বা জীবনের বৃহদাংশ প্রকাশ্য গুনাহ ও নাফরমানিতে লিপ্ত থেকেছে, তারপর তার শেষ পরিণতি সুস্পষ্ট মন্দ হয়েছে, তার জন্য আল্লাহ তাআলার দয়ার আশা করা যায় না। যেসব জঘন্যতম অন্যায় কর্মকান্ড আল্লাহ তাআলা নিষিদ্ধ করেছেন, সেগুলির সাথে অবাধে চলাফেরা করা ব্যক্তির জন্য দয়ার একটি মাত্রা রয়েছে। তাদের জীবনের শেষ পর্যন্ত মানবিক দয়া এবং এ আশাও করা যে. সে হয়ত সে আল্লাহ তাআলার পথে ফিরে আসবে (সেজন্য চেষ্টা ও দোআ করা) — এতটুকুই। ফিরে যখন আর এলই না, এখন আর কীসের দয়া?! যদি আল্লাহ না করুন, এসব কাফেরের জন্য আমাদের কারু দয়া-মায়া লাগে (এই কুফরীতে তারা মৃত্যু পর্যন্ত অটল থাকার পরও) তাহলে কিন্তু আল্লাহ তাআলার দয়া ও ক্ষমা আমাদের থেকে ঠিক সেভাবে সরার আশঙ্কা হবে যেভাবে তাদের থেকে আল্লাহ তাআলার দয়া সরেছে (নাউযুবিল্লাহ!)।
যেসব আমল বা কাজের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা দয়ার কথা বলেননি, বলেছেন কঠোর শাস্তি, অভিশাপ ও চির লাঞ্ছনার কথা, সেখানে যেন আমরা কখনোই আল্লাহ তাআলার দয়ার কথা বলে নিজেকে শয়তানের মহা প্রবঞ্চনার শিকার না বানাই।
মুমিন অবস্থায় মৃত্যু হলে
তবে সঙ্গে সঙ্গে একথা তো স্মরণ ও বিশ্বাস রাখতেই হবে যে, মুমিন ব্যক্তির জন্য যেহেতু তওবার দরজা খোলা আছে তাই তার হয়ত তওবা নসীব হবে। সেজন্য তাকে আল্লাহ তাআলার দয়ার বাইরে বলা করা যাবে না। সে গুনাহের কারণে শাস্তির উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও ঈমানের কারণে যেকোনো মূহূর্তে আল্লাহ তাআলার দয়া প্রাপ্ত হতে পারে আর শেষমেষ তো হবেই। মুমিনগণের ব্যাপারে এটিই আল্লাহ তাআলার রীতি (আলহামদুলিল্লাহ!)।
মুসলমানদের সন্তানদের জন্য হুঁশিয়ারী
কখনো এমনও দেখা যায় যে, মুসলমানদের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও (মুফতে ঈমান পেয়েও) অনেকে জীবনের বৃহদাংশে এমন বল্গাহীন দিন অতিবাহিত করে যে সেই ব্যক্তির শেষ পরিণতি বাহ্যত খুবই মন্দ হয়ে থাকে। সুনিশ্চিতভাবে এমন ব্যক্তি যদি মুরতাদ না হয়ে থাকে, কেবল কবীরা গুনাহে লিপ্ত থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়, তবু অবশ্য তার জানাযা পড়া হবে। অর্থাৎ তার জন্য মাগফেরাতের দোআ করা যাবে/করতে হবে। এক্ষেত্রে ভয়ের কথা হল, ক্রমাগত কবীরা গুনাহে লিপ্ত হওয়া ব্যক্তির মৃত্যুর সময় ঈমান নসীব হওয়ার বিষয়টি চরম হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। কারো কারো তো এমনটি প্রকাশ্যেই হয় (আজ পর্যন্ত বহু ঘটনা তার প্রমাণ)। তাকে তালকীন করা হলে, অর্থাৎ মৃত্যু শয্যায় তাকে কালেমা পড়তে বলা হলে, সে কালেমা পড়তে সরাসরি অস্বীকৃতি জানায় (নাউযুবিল্লাহ)।
বাস্তবিকই, আল্লাহ তাআলার বল্গাহীন নাফরমানি আজ অনেক মুসলমান সন্তানদেরকে এমনভাবে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে এবং এমনভাবে কাফেরদের প্রকাশ্য কুফরী সংস্লিষ্ট কাজে জড়িয়ে ফেলছে যে. বলার অপেক্ষা রাখে না তারা (ঐসব মুসলামান সন্তানেরা) আসলে ঈমানের গন্ডি থেকে বের হয়ে গেছে (নাউযুবিল্লাহ)। এটা তখনই হয় যখন তারা বেঈমান ও মুরতাদ হওয়ার কাজ করে বসে (এরাও এ অবস্থায় আল্লাহ তাআলার দয়া থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে যায়)। ঈমানের মতন অমূল্য সম্পদ পেয়ে তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলাটি সত্যিই চরম দুর্ভাগ্যের ব্যাপার! ঈমানের বদৌলতে মানুষকে চির-আগুন থেকে দূরে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। আর আমাদের কত হাজার-লাখো সন্তানেরা আজ সেই চির-আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার পথটাই বেছে নিয়েছে! সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হল, আমরাও নীরব দর্শকের মতন তা দেখছি।
শেষ কথা
এ প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হল এতটুকু বলা যে, আজ আমরা যদি আল্লাহ তাআলার দয়াকে এমনভাবে বুঝি আর বলি যে স্বয়ং তাঁর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমরা ভুল ধারণা ও বিশ্বাসে পর্যবসিত হই – এটা আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এসব চিন্তা, চেতনা, ধারণা ও বিশ্বাস আমাদেরকে মূলত ভালো কথার মোড়কে আল্লাহ পাকের মারাত্মক নাফরমানিতে লিপ্ত করে দেয়। এটা শয়তান ও নফসের কূটকৌশল ছাড়া আর কিছু নয়!
হে আল্লাহ! আপন রহমতে আমাদেরকে তুমি সাহায্য কর, আমাদের ঈমান ও নেক আমলকে তুমি সুরক্ষা কর। আমীন।
Last Updated on March 21, 2023 @ 10:53 am by IslamInLife বাংলা