আখলাক ও আত্মশুদ্ধিচিন্তার খোরাক​

আত্মসংশোধনে গুরুত্বের সঙ্গে সচেতন হওয়া জরুরি

যে বিষয়টি নিয়ে লিখতে যাচ্ছি সেটি নিয়ে লিখতে ভয় হচ্ছে। এর মূল কারণ হল, বিষয়টি যদিও মৌলিক কিন্তু বড় মানুষদের হাতে এমন লেখা সাজে (মানায়)। আমাদের মতন ছোট মানুষদের হাতে নয়। বড় মানুষেরা এসব লেখেন নিজ জীবনের সুদৃঢ় ঈমান ও আমল নিয়ে। আমাদের মতন মানুষ তাত্ত্বিক (theoretical) কিছু জেনে লিখে ফেলি। অর্থাৎ নিজের কথাই বলছি।

তারপরও লিখছি এজন্য যে, হতে পারে সঠিক ও সত্য কথার বরং কুরআন ও সুন্নাহ-সম্মত কথার আলোচনার বরকতে তত্ত্ব (theory) বাস্তব জীবনে, নিজ ঈমান-আমলে সুপ্রভাব ফেলবে (আল্লাহ তাআলা চাইলেই সম্ভব)! আল্লাহ তাআলার কাছে দুর্বল বা গুনাহাগার বান্দাদের তওবা আর আফসোস, নিয়ত আর প্রচেষ্টার মূল্যমান কি কম? এমন মনে করা তো সম্পূর্ণ অনুচিত।

আর এসব কোনো নতুন কথা নয়! বরং উলামাগণ বার বার বিভিন্ন ভাবে আলোচনা করেন। সেগুলোরই একটি সহজ সরল উপস্থাপনার প্রচেষ্টা মাত্র!

মূল আলোচনা শুরু করছি..আল্লাহ তাআলা সাহায্য করুন।

বিপদাপদে ও প্রতিকূলতায় অথবা সাধারণ অবস্থায়ও বান্দার যে সব আশা-আকাঙ্ক্ষা মনে দোল খায়, সেগুলোর দুটি দিক। একটি তো নাজায়েয, যদি ইচ্ছাকৃত করা হয় সেটা স্বতন্ত্র গুনাহই। এই দিকটি নিয়ে আলোচনা প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল, একজন ঈমানদার যখন সাধারণ অবস্থায় থাকেন, কাজকর্ম-চিন্তা ভাবনা করেন অথবা বিপদাপদে পড়েন সেটা যে জাতীয়ই হোক, তখন তার চিন্তা-ভাবনা ও আল্লাহ-মুখীতা কেমন হবে, তার কাজকর্ম কেমন হবে। কিভাবে সে সিদ্ধান্ত নেবে। কিভাবে সে হায়াত অতিবাহিত করবে — এ প্রসঙ্গ।

যে দিকগুলো নিয়ে আমাদের সমস্যা ব্যাপক এমনকি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে

প্রথমেই বলি, দুনিয়ার হায়াত বা জাগতিক জীবনের হাকীকত বা বাস্তবতা না জানা, অথবা তা জানার চেষ্টাও না করা আজ এক স্বতন্ত্র সমস্যা।

তারপর রয়েছে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব, পরিবেশ-মহলের শিক্ষা-দীক্ষা।

এছাড়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নিজের অভ্যন্তরীণ অবস্থা বা আত্মিক অবস্থা। কতটুকু তা উন্নত বা অবনত। নেকের পথে কতটুকু প্রগতিশীল বা মন্দের দিকে কতটুকু ধাবমান। এখানে নিয়ত, জীবনের উদ্দেশ্য, চেষ্টা-প্রচেষ্টা সবকিছুর প্রভাবই বিদ্যমান।

যদিও পরিবেশ বা মহল সংশ্লিষ্ট কথাই, তবু পৃথকভাবে উল্লেখ করছি: ঘনিষ্ঠ সঙ্গী-সহচর কে বা কারা(?)

খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, দ্বীনী ইলম অর্থাৎ ইসলামের মৌলিক জ্ঞান কতটুকু অর্জিত আছে আর তা কতটুকু বাস্তবিকই আমলে রয়েছে।

দ্বীনি কাজের আগ্রহ-উদ্দীপনা আমাদের অনেকের রয়েছে, যেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু নিজ জীবনের ও নিজ পরিবারের মুয়ামালাত-মুআশারাতে বরং আখলাকে পর্যন্ত দ্বীনদারির অনেক অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ এগুলো বিনা চিকিৎসায় বা অবহেলার শিকার। কিন্তু অন্যের সংশোধন চিন্তায় আমরা রাত-দিন বিভোর থাকছি। এ আয়াতটির অর্থ ও মর্ম যেন আমি ভুলে গিয়েছি:

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ قُوٓا۟ أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًۭا وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَـٰٓئِكَةٌ غِلَاظٌۭ شِدَادٌۭ لَّا يَعْصُونَ ٱللَّهَ مَآ أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ 

অর্থ: হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যেখানে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ।  আল্লাহ তাআলা তাদেরকে যা আদেশ করেন, সেটি তারা কখনো অমান্য করে না এবং যা-ই আদেশ করা হয় সবসময় তারা তা-ই করে। সুরা তাহরীম:৬

উপকারী মুরাকাবা (গভীর চিন্তা-অনুসন্ধান)

এই বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে একজন ঈমানদার যদি চিন্তা-ফিকিরে মগ্ন হন, পুরোপুরি না হলেও ইনশাআল্লাহ কিছু সত্য তার সামনে উদ্ভাসিত হবে। বিলম্ব না করে তখনই তাকে আল্লাহ পাকের কাছে আন্তারিক দোআ করে শরণাপন্ন হতে হবে কোনো আলেম অথবা আল্লাহওয়ালার কাছে। সাধারণভাবে সমাজে পীর/ফকির/কবিরাজের কাছে নয়! তার চেয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে যান!

যারা আরো একটু এগিয়ে গেছেন, তারাও দেখবেন, তত্ত্ব ও বাস্তবতা একরকম নয়, সবসময় মিলে না। কুরআন-সুন্নাহ অধ্যায়ন করেও মেলাতে পারছেন না অনেক ক্ষেত্রে। কারণ কুরআন-সুন্নাহ বিস্তৃত ও গভীর জ্ঞান না থাকলে সেটি বাহ্যতই সম্ভব নয়। মুহাক্কিক কোনো আলেমে-দ্বীনের সঙ্গ আসলে অনেক বড় নেয়ামত! কিন্তু এটি বোঝার চেষ্টা করার লোকই কম। মুহাক্কিক কোনো আলেমে-দ্বীনের কাছেই রয়েছে দ্বীন দুনিয়ার জটিল প্রশ্নের সমাধান। তারা যদি স্পষ্ট বলেও থাকেন, “এ মুহূর্তে এর কোনো কারণ বুঝে আসছে না”, এমন কথাটিও তারা কত বিস্তৃত ও গভীর ইলমের মহাসমুদ্রে ডুব দিয়ে তারপর বলে থাকেন, আমাদের মতন অনেক তত্ত্ব-জ্ঞানী সেটি বুঝব না।

আমাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও কাজের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার এক বড় কারণ হল, আমরা দুনিয়ার কোনো ফাঁদে পড়ে নিজেরাই অনেক কিছু বুঝে ফেলার আকাঙ্ক্ষা তো করিই, দাবীও করে বসি! তা হোক দুনিয়ার কোনো বিষয় অথবা দ্বীনি। দ্বীনি বিষয়ে ঈমানদারের বিকৃত চিন্তা তাকে মারাত্মক ক্ষতিতে ফেলে দিতে পারে। আল্লাহ তাআলার প্রতি না-শোকর হওয়া, বেসবর হওয়া, মন মতন কিছু না হলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠা কয়েকটি উদাহরণমাত্র।

ক’জন বড় আলেম/ফকীহ আর ক’জন সাধারণ মানুষ

এখানে একটি কথা বলি, যেটি বলা জরুরি মনে হচ্ছে। সবাই মুহাক্কিক অর্থাৎ অনেক তাহকীকি (কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক গবেষণা) ইলমওয়ালা নন, হবেনও না। সহজে বুঝুন, গভীর দ্বীনি জ্ঞানের অধিকারী সব মানুষ হবে না। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লক্ষ লক্ষ সাহাবা ছিলেন। সাহাবা রাদিআল্লাহু আনহুম মাঝে ক’জন ফকিহ শ্রেণীর আলেম ছিলেন? খুব কম। বাকিদের অবস্থান তাহলে কী ছিল? বাকি সব সাহাবা সঠিক-সত্যের ইত্তেবাকারী (অনুসারী) ছিলেন মাশাআল্লাহ! উম্মতের মাঝে সবচেয়ে মুত্তাকী-পরহেযগার ছিলেন। প্রতি যুগে এমন হয়েছে, হবে, হতে থাকবে। আসুন সাধারণ থাকি। নিজেকে নিজে বড় বানিয়ে না ফেলি! যাদেরকে আল্লাহ তাআলা বড় বানিয়েছেন তাদেরকে অনুসরণ করি। তাহলে নিজের সাধ্য-সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ হবে। ইনশাআল্লাহ এতে বরকত অনে–ক বেশি। বরং এতেই বরকত রয়েছে।

সঠিকভাবে না জেনে আমল করা আমাদের বড় রোগ

দ্বীনি শ্রেণীর মানুষ আমরা অনেক রকম ভ্রান্তির শিকার হই শুধু সঠিকভাবে না জেনে আমল করার কারণে। কিছু জানা পর্যন্ত অনেক কিছুকে আমরা স্থির করে ফেলি, ততটুকুই যথেষ্ট মনে করি। উন্নতির পথ যে কত বাকি, নিজের অবস্থা যে নিজে পুরোপুরি আমরা জানি না, আত্মতুষ্টি যে নফস্ ও শয়তানের ফাঁদ — এগুলো বেমালুম ভুলে যাই বা অন্যকে নসীহত করে নিজে এগুলো নিয়ে চিন্তা ফিকির করি না! কারণ, ঐ যে..! মনে করি আমার তো এ মোকাম হাসিল!! আহা, অথচ অনেক সরল-প্রাণ, যেমন: গ্রাম্য কোনো ব্যক্তিও আমার তুলনায় লক্ষ-কোটি মাইল আল্লাহর পথে এগিয়ে থাকতে পারে। একদমই অসম্ভব নয়। বরং বেশি সম্ভব।

কুরআন-হাদীসের অধ্যায়ন, প্রচার প্রসার, দরস-তাদরীস, তাবলীগ, তাযকিয়া যে অঙ্গনেই বলুন, আমার মতন মানুষের হাহাকার কেন? আমার ব্যক্তি জীবন, আমার পারিবারিক জীবন, আমার সামাজিক জীবনে ইসলামের নাম-গন্ধ কতটুকু আছে, আমি নিজেই দেখছি।

কোন্ উদ্দেশ্যকে আমি দ্বীনি উদ্দেশ্য ভেবে বসে আছি। কোন্ পথে আমি আত্মতুষ্টির ছায়ায় প্রশান্ত? আমার নামাযের মতন ইবাদত দিয়েই যদি নিজেকে যাচাই করা শুরু করি, তাহলেই তো অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠছে! (যেমন নিজেকেই আমরা প্রশ্ন করি: ইবাদত-শ্রেষ্ঠ নামাযে আমি কি সেরকম যত্নবান, যতটুকু সহজেই হওয়া যায়?)

এ আলোচনার উদ্দেশ্য কী

এই যে আলোচনা-সমালোচনা, এটি আমার মূলত নিজের উপকারের জন্য বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে। অন্যের দিকে বন্দুক তাক করে বসে থাকলে তো নিজের কোনো উন্নতি চোখেই পড়বে না! আর এসব আলোচনা বা চিন্তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার অর্থ কিন্তু আমাদের মাঝে হতাশা ও দুশ্চিন্তা উদ্রেকে সৃষ্টির জন্য নয়!! সতর্কতা ও সচেতনা তৈরির জন্য। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

وَذَكِّرْ فَإِنَّ ٱلذِّكْرَىٰ تَنفَعُ ٱلْمُؤْمِنِينَ 

অর্থ: এবং বোঝাতে (আরেকটি তরজমা আলোচনা করতে) থাকুন; কেননা, বোঝানো (আলোচনা করা) মুমিনদের উপকারে আসবে। সুরা যারিয়াত: ৫৫

চিন্তাকে মধ্যমপন্থায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে, আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও মহত্ব চিন্তা করে তাঁরই শাহী দরবারে আমাদের প্রত্যেককে সেজদায় লুটিয়ে ক্ষমা চেয়ে জীবনে সংশোধন আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। এটিই তো আমাদের আমরণ-আজীবনের সাধনা!

Last Updated on December 4, 2023 @ 8:54 am by IslamInLife বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it