যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব ও অন্যান্য বিষয় – ২
জবাইয়ের আগে কুরবানীর পশু থেকে উপকৃত হওয়া
কুরবানীর পশু কেনার পর বা নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে কোনো ধরনের উপকৃত হওয়া যাবে না। যেমন : হাল-চাষ করা, আরোহণ করা, পশম কাটা, দুধ দোহন করা ইত্যাদি। সুতরাং কুরবানীর পশু দ্বারা এসব করা যাবে না। যদি করে তবে পশমের মূল্য, হালচাষের মূল্য দুধ বা (খেয়ে ফেললে) তার মূল্য ইত্যাদি সাদকা করে দিতে হবে।
জবাই সংক্রান্ত মাসায়েল
স্বহস্বে কুরবানী করা উত্তম। নিজে যদি ভালোভাবে কুরবানী করতে না পারে তবে নিজে উপস্থিত থেকে অন্যের দ্বারা করানোই সমীচীন। অবশ্য পর্দার ব্যবস্থা না থাকলে মেয়ে লোক উপস্থিত হবে না। অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রত্যেককে নিজ নিজ জবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ঐ কুরবানী সহীহ হবে না।
কুরবানীর পশুকে ক্ষুধা-পিপাসায় কষ্ট দিয়ে জবাই করবে না। পশুর সামনে ছুরি, চাকু ধার দিবে না। এক পশুকে আরেক পশুর সামনে জবাই করবে না। খুব ধারালো অস্ত্র দ্বারা ভালোরূপে জবাই করবে যেন কোনো রগ না থেকে যায়। জবাইয়ের সময় প্রাণীকে অধিক কষ্ট দিবে না, জবাইয়ের পর পশু নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনোো অঙ্গ কাটা মাকরূহ।
জবাইয়ের আগে দোআ পড়ে নিবে। নিম্নে লিখিত দোআ পাঠ করা মুস্তাহাব :
انى وجهت وجهى للذى فطر السماوات والارض حنيفا وما انا من المشركين، ان صلاتى ونسكى ومحياي و مماتى لله رب لاشريك له و بذلك امرت وانا اول المسلم العالمينين ـ
পূর্ণ ইখলাছ ও তাওহীদের সাথে এই দোআ পড়ে পশুটিকে কিবলামুখী করবে এবং ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করবে।
জবাইয়ের পর এই দোআ করবে :
اللهم منك ولك، اللهم تقبل منى كما تقبلت من حبيبك محمد و خليلك ابراهيم عليهم الصلاة والسلام ـ
‘ইয়া আল্লাহ! তোমার পক্ষ থেকে এবং তোমারই উদ্দেশ্যে। আমার এ কুরবানী কবুল করুন যেমন কবুল করেছেন আপনার হাবীব মুহাম্মদ ﷺ এবং আপনার খলীল ইব্রাহীম عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ -এর পক্ষ থেকে।’
কুরবানী যদি অন্যের পক্ষ থেকে হয় তাহলে (منى) এর পরিবর্তে مِنْ এরপর ব্যক্তির নাম বা (منا) বলবে।
কুরবানীর পশুতে শরীকানা প্রসঙ্গে
ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী করতে পারবে। এমন একটি পশু একাধিক ব্যক্তি মিলে কুরবানী করলে কারোরটাই সহীহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না।
সাতজন মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের চেয়ে কম হতে পারবে না। যেমন : কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না।
উট, গরু, মহিষ, সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন : দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী সহীহ হবে না। এমন ব্যক্তিকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানী সহীহ হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করা উচিত।
শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না।
যদি কেউ গরু, মহিষ বা উট একা কুরবানী দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয় তাহলে ইচ্ছা করলে অন্যকে শরীক করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে একা কুরবানী করাই শ্রেয়। শরীক করলে সে টাকা সাদকা করে দেওয়া উত্তম। আর যদি ঐ ব্যক্তি এমন গরীব হয় যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়, তাহলে সে অন্যকে শরীক করতে পারবে না। এমন গরীব ব্যক্তি যদি অন্যকে শরীক করতে চায় তাহলে পশু কেনার সময়ই নিয়ত করতে হবে।
শরীকানার ভিত্তিতে কুরবানী করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরীকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করার অনুমতি দিয়ে দেয় তবে তা জায়েয হবে। নতুবা ঐ শরীকের টাকা ফেরত দিতে হবে। অবশ্য তার স্থলে অন্যকে শরীক করা যাবে।
শরীকে কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বন্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়।
কুরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকীকা এবং হজ্বের কুরবানীর নিয়ত করা যাবে। এতে প্রত্যেকের নিয়তকৃত ইবাদত আদায় হয়ে যাবে।
কুরবানীর গোশত, চর্বি, হাড়, চামড়া ইত্যাদি
ঈদ-উল-আযহার দিন সর্বপ্রথম নিজ কুরবানীর গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত। অর্থাৎ, সকাল থেকে কিছু না খেয়ে প্রথমে কুরবানীর গোশত খাওয়া সুন্নত। এই সুন্নত শুধু ১০ জিলহজ্বের জন্য। ১১ বা ১২ তারিখের গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত নয়।
কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর গোশত খাওয়া মুস্তাহাব।
কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশিকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য এক তৃতীয়াংশ সাদকা করা জরুরি নয়। যার সামর্থ্য আছে তিনি এর চেয়ে বেশিও সাদকা করতে পারেন। আর যার ঘরে প্রয়োজন রয়েছে তিনি এর চেয়ে কমও করতে পারেন আবার পুরোটাও রেখে দিতে পারেন।
কুরবানীর গোশত বিধর্মীকে দেওয়া জায়েয।
জবাইকারী, কসাই, কাজে সহযোগিতাকারী, বাড়ির কাজের লোকসহ কাউকেই চামড়া, গোশত বা কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েয নয়। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারি দেওয়া যাবে।
কুরবানীর পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া নেওয়া জায়েয। ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো কাজের লোককে গোশত খাওয়ানো জায়েয। তবে কুরবানীর পশুর কোনো কিছু তাদের পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া যাবে না।
কুরবানীর গোশত, চর্বি, হাড় বা অন্য কোনো কিছু বিক্রি করা জায়েয নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সাদকা করে দিতে হবে।
কুরবানীর চামড়া কুরবানীদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। চামড়া বিক্রি করলে মূল্য সাদকা করার নিয়তে বিক্রি করবে। সাদকার নিয়ত না করে নিজের খরচের নিয়ত করা নাজায়েয ও গুনাহ। তবে নিয়ত যা-ই হোক বিক্রিলব্ধ অর্থ পুরোটা সাদকা করে দিতে হবে।
চামড়া বা তার মূল্য প্রয়োজনগ্রস্ত পরহেযগার দ্বীনদার ব্যক্তিকে দিবে। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যদি কেউ এমন থাকে তবে তাকে সাদকা করলে সাদকা করার এবং আত্মীয়তার হক রক্ষা করার সওয়াব পাবে। কুরআন-হাদীসের চর্চা হয় এমন কোনো এতিমখানায় বা লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে দিলে কুরআন-হাদীসের খেদমত করার এবং সাদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পাওয়া যাবে।
অপরিচ্ছন্নতা ইসলামে সমর্থিত নয়
যেকোনো কাজ তখনই পূর্ণাঙ্গ হয়েছে বলে বিবেচিত হয় যখন তা শেষ পর্যন্ত সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া হয়। ইসলাম পবিত্রতার ধর্ম, অপরিচ্ছন্নতা ইসলামে সমর্থিত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে কাউকে কষ্ট দেওয়া গুনাহের কাজ। তাই কুরবানীর পশু জবাই করার পর তার রক্ত নাড়ি-ভূড়ি ও অন্যান্য আবর্জনা যত্রযত্র ফেলে না রাখা ইবাদতটির পূর্ণতার জন্য জরুরি। ইবাদতের পূর্ণাঙ্গতার জন্য এসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখা অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহই উত্তম তাওফীক দাতা।
وصلى الله على سيدنا و مولانا محمد وعلى آله و صحبه أجمعين،
والحمد لله رب العالمين
Last Updated on July 2, 2024 @ 4:33 pm by IslamInLife বাংলা