হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রাযিআল্লাহু আনহু (মৃ. ৩৬ হিজরী : ৬৫৬ খৃস্টাব্দ)
মুখে উচ্চারণ করার আগে যাঁর হৃদয় ছিল ঈমানে টইটম্বুর। মহানবী ﷺ যাঁকে মুহাজির বা আনসার সাহাবা কেরামের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ প্রদান করেছিলেন। কপটতার বিরুদ্ধে দ্রোহ ও দ্রোহিতাই যাঁর সহজাত স্বভাব। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর মনের গোপন কথা যিনি সযত্নে গোপন রাখতেন। গোপন তথ্য যিনি পেটে রাখতেন গভীর দায়িত্ববোধ নিয়ে। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যাঁর কাছে মহানবী ﷺ মুনাফিক লোকদের নামগুলো প্রকাশ করেছিলেন। স্নেহময়ী মায়ের হাতে যাঁর ঈমান ও বিশ্বাসের খড়ি। যে মমতাময়ী মা পরম মমতার হাতে যাঁকে বড় করেছিলেন রাসূলের ভালোবাসায় এবং যিনি দু’চোখে রাসূলকে দেখার আগে ঈমানের দৌলত পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন তিনি হলেন হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা.।
জন্মগ্রহণ করেছিলেন এমন ঘরে যে ঘরানা লোকদের অন্তরে ছিল কুরআন। যাঁদের মনের গহীনে লালিত হতো রাসূল ﷺ-এর যিয়ারতের স্বপ্নসাধ। তাই কাঁধে লাঠি নিয়ে ছুটে চললেন মক্কা নগরীর উদ্দেশ্যে। নিজেকে সঁপে দিলেন রাসূলের কোলে। তাঁর সামনে আবেগের সবটুকু মাত্রা ঢেলে দিলেন। থাকতেন রাসূল ﷺ-এর সাথে। হিজরতের পর রাসূলের সাথে ছায়ার ন্যায় ছিলেন। দু’চোখের সঙ্গের ন্যায় মহানবী ﷺ-এর সঙ্গী ছিলেন।
মেজাজ ছিল পরিচ্ছন্ন। (পাহাড়ি ঝরনার উপলধোয়া পানির) স্বচ্ছতা ছিল তাঁর প্রকৃতিতে। জানতেন না মুনাফেকি ও কপটতা কী জিনিস। হৃদয়ের দীপ্তি ও পরিচ্ছন্নতা ইসলামের আলোয় আরও দ্যুতি ছড়ালো। যাপিত জীবনে ছিল দূরদর্শিতা। মহানবী ﷺ যাঁর কাছে প্রকাশ করেছিলেন মুনাফিক লোকদের নাম। হুযাইফা রা. ব্যতীত অন্য আর কাউকে নবীজী ﷺ এই গোপন রহস্য জানাননি।
এ কারণেই হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. কেবল সেই লোকের জানাযার নামায পড়তেন যার জানাযার নামায হযরত হুযাইফা রা. পড়তেন। পাছে না কোন মুনাফেকের জানাযার নামায পড়তে হয়। কাফের লোকেরা বদর অভিযানে বাদ সাধায় তিনি তাতে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এরপর সকল সমর অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সর্বদা অনিষ্টের শঙ্কাজনিত অগ্নিতে দগ্ধ হতে থাকতেন। কেবল শ্রোতৃম-লীর আগ্রহের সময় কথা বলতেন, উপদেশ দিতেন। অন্যথায় সবসময় নীরবতা পালন করতেন। যখন কথা বলতেন মুখ দিয়ে নিঃসৃত হতো মুক্তা আর জ্যোতি।
তিনি তাঁর অবস্থা ও অভিলাষের কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন যে, মহানবী ﷺ-কে লোকজন কল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতো। আর আমি অনিষ্টের আশংকায় সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম। তিনি মানুষকে ওয়াজে বলতেন, ফেতনার স্থান থেকে সতর্ক থাকো। জিজ্ঞাসিত হলেন, ফেতনার স্থান কোনটা? বললেন, শাসকের দরজা। তোমাদের কেউ আমীরের দরবারে গেলে মিথ্যার বেসাতি নিয়ে সে হাজির হয় এবং অন্যায় কথা বলে বেড়ায়।
তিনি বলতেন, আমার একান্ত ইচ্ছা যদি এমন কেউ থাকতো যে আমার ধনসম্পদ পরিশুদ্ধ করে দিতো। এরপর আমৃত্যু আমি বাড়িতে থেকে যেতাম। কারো সঙ্গে আমার আর কোন ধরনের দেখা-সাক্ষাত না হওয়ার লক্ষ্য সে লোক আমার দরজা বন্ধ করে দিবে। তিনি বলেছেন, সর্বপ্রথম যে জিনিস তোমাদের দ্বীন থেকে হারাবে তা হল বিনয়। সর্বশেষ তোমরা তোমাদের দ্বীন থেকে হারাবে নামায।
ছোট আশায় থেকে ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিলেন। পরকালের যাত্রার আগে তিনি তাঁর কার্যক্রম পূর্ণ করেছিলেন। একদিন হযরত হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা.-এর সাথে ভোরবেলায় হযরত আবূ হুরাইরা রা. এর সাক্ষাত হয়েছিল। হুযাইফা রা. বললেন, আপনাকে দেখি বাথরুমে যাওয়ার সময় ধীরে ধীরে যান। আর বাথরুম থেকে বের হয়ে তাড়াহুড়ো করেন। উত্তরে হযরত আবূ হুরাইরা রা. বললেন, বাথরুমে প্রবেশের সময় আমার উযূ থাকে। তাই ধীরে ধীরে হেঁটে যাই। পক্ষান্তরে বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় আমার উযূ থাকে না। পাছে উযূ করার আগেই আমার মৃত্যু হয়ে যায় কিনা তাই আমি দ্রুত হেঁটে গিয়ে উযূ করে নিই। হুযাইফা রা. বললেন, এটা তো অনেক আশার কথা বললেন। আমি তো কদম উঠানোর পরক্ষণেই আশঙ্কায় থাকি, না জানি কদম রাখার আগেই আমার মৃত্যু হয়ে যায়।
নিজের অবস্থা ও ইবাদত-বন্দেগীর বিষয়গুলো তিনি খুব গোপন রাখতেন। একবার তিনি নামায পড়তে পড়তে কাঁদলেন। নামায শেষে তাকিয়ে দেখেন, এক লোক তাঁর পেছনে থেকে কান্নার আওয়াজ শোনে ফেলেছে। সে লোক নামাযে তাঁর কান্নার কথা অন্যের কাছে বলে দেয় কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত হলেন। তিনি সে লোককে বিনীতভাবে অনুরোধ করলেন, তুমি আমার কান্নার বিষয়টা অন্য কারো নিকট জানাবে না।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. যখন কোন সমর অভিযানে মুজাহিদ কাফেলা পাঠাতেন, তখন তিনি কাফেলার লোকদেরকে লিখিতভাবে ফরমান জারি করতেন, আমি তোমাদের নিকট আমীর হিসেবে অমুককে পাঠালাম। তাকে বিভিন্ন নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছি। সুতরাং তোমরা তাঁর আনুগত্য করো। কিন্তু যখন হযরত হুযাইফা রা.-কে মাদায়েন অভিমুখে পাঠালেন তখন তিনি মুজাহিদ বাহিনীকে লিখিতভাবে জানালেন, আমি তাঁকে তোমাদের নিকট শুধু আনুগত্য ও মান্য করার জন্যই পাঠিয়েছি। তারা বলল, তিনি তো অনেক বড় মানুষ। তারা তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে মদীনার উঁচু এলাকায় আরোহী অবস্থায় জড়ো হল। তারা দেখলো, হুযাইফা রা. খচ্চর চড়ে আসছেন। বাহনের এক দিকে দু’পায়ে আরোহী অবস্থায় হযরত হুযাইফা রা.-কে দেখে তারা চিনতেই পারেনি। তারা লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলো, মহামান্য আমীর কোথায়? লোকজন বলল, তোমরা যাঁকে দেখেছো তিনিই তোমাদের আমীর। শোনে তাঁর পেছনে দৌড়িয়ে তারা নাগাল পেয়ে যায়। তখন তাঁর হাতে ছিল সামান্য শুষ্ক রুটি। তারা তাঁকে সালাম দিল। তারা বলল, বলেন কী আপনার হুকুম। তিনি বললেন, আমার জন্য এবং বাহনের খাবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো।
তিনি সেখানে বেশ কিছু দিন ছিলেন। পরবর্তীতে হযরত উমর রা. তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তিনি মদীনায় আগমনের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। হযরত উমর রা. তাঁর আগমনের খবর পেয়ে পথিমধ্যে আত্মগোপনে অবস্থান করতে লাগলেন। দেখলেন, মদীনা থেকে পাঠানোর সময় হুযাইফা রা. যেমন ছিলেন মাদায়েন থেকে ফেরার সময়ও তেমন আছেন। এ অবস্থা দেখে হযরত উমর রা. আনন্দিত ও হাস্যোজ্জ্বল বদনে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, তুমি আমার ভাই আর আমি তোমার ভাই।
শেষ রাতে হযরত হুযাইফা রা. টের করতে পারলেন যে, তাঁর মৃত্যু সন্নিকটে। এতে তিনি প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠলেন, কাঁদতে লাগলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন, দুনিয়ার প্রতি আমার কোন আফসোস নেই এবং পার্থিব কোন বিষয়ে দুঃখ নেই। মৃত্যু আমার অনেক প্রিয় জিনিস। কিন্তু আগামী জীবন সন্তোষ না অসন্তোষের তা আমার জানা নেই। এরপর ক্ষীণ আওয়াজে বললেন, তখন প্রচণ্ড ব্যথায় ব্যথিত, এখন কোন্ সময়? লোকজন বলল, শেষ রাত। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে বসাও। তারা তাঁকে বসাল। এরপর তিনি বললেন, আমাকে কিবলামুখী করো বসাও। তারা তাঁকে কিবলামুখী করে বসালে তিনি হাত তুলে দোআ করতে লাগলেন, (অনুবাদ) হে আল্লাহ! আমি সকালের জাহান্নাম থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই। আল্লাহ! তুমি তো জানো যে, আমি ধনাঢ্যতার চেয়ে দারিদ্র্য পছন্দ করি। লাঞ্ছনার চেয়ে সম্মানকে শ্রেয় মনে করি। জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে অগ্রাধিকার প্রদান করি। এই টানাটানির মাঝে দোস্তের আগমনে আমি শরমিন্দা।
এরপর তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা কি কাফন নিয়ে এসেছো? তারা বলল, হাঁ। তিনি বললেন, তোমরা প্রয়োজনের বেশি কাফনের কাপড় আমার গায়ে জড়াবে না। কারণ আমি যদি আল্লাহ তাআলার কাছে প্রিয়পাত্র হতে পারি, তিনি তো আমার এই কাফনের কাপড় পরিবর্তন করে দিবেন। আর যদি পরিণাম অন্যথা হয় তাহলে তো এই মূল্যবান কাফন থাকবে না। এরপর তিনি হাত বাড়ালেন যেন তিনি মৃত্যুর সাথে হাত মেলাচ্ছেন। এরই মধ্যে তাঁর আত্মা পরলোকে গমন করে। হিজরী ৩৬ সালে মাদায়েন শহরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।