হাসসান ইবনে আবী সিনান রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৫১ হিজরী : ৭৬৮ খৃস্টাব্দ)
অহেতুক একটি প্রশ্ন, কত বছর আগে এই কুঠরিটি নির্মিত হয়েছে?, মন ও প্রবৃত্তি কর্তৃক এই প্রশ্ন করার থেকে এক বছর ধরে সিয়ামসাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। তাকওয়া যার দু’চোখের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিয়েছিল। সিয়ামসাধনার সায়রে অবগাহন করে যিনি মুক্তা আহরণ করেছিলেন। তিনি হাস্সান ইবনে আবী সিনান। বসরা নগরীর অধিবাসী। অন্যতম মুত্তাকী ও ইবাদতগুজার ব্যক্তি। আরবী, ফারসী ও হিব্রু ভাষায় হস্তলিপি ছিল তার পেশা। হাসান বসরী রহ. এবং সাবিতুল বুনানী রহ. থেকে অনেক বর্ণনা করেছেন। বর্ণনার তুলনায় ইবাদত বেশি করেছেন। কেউ তাকে দেখলে মনে হবে তিনি একজন অসুস্থ ব্যক্তি।
তিনি বলেন, তাকওয়া কত সহজ! সন্দেহ হলেও বাদ দিয়ে দাও। এটাই তাকওয়া। হযরত হাস্সান ইবনে আবী সিনান রহ. রাস্তার পাশে নির্মিত একটি কুঠরির পাশ দিয়ে অতিক্রম করে গেলেন। বললেন, কত দিন আগে এই কুঠরিটি নির্মিত হয়েছে? এ কথা বলার পরক্ষণই তিনি নিজেকে তিরস্কৃত করতে লাগলেন, কখন থেকে এটি নির্মিত হয়েছে এ নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর কী আছে? অনর্থক বিষয় নিয়ে কেন প্রশ্ন করছো? অহেতুক এই ভুলের জন্য একবছর ধরে রোযা রাখলেন।
এক যিকিরের মজলিসে ইউনুস ইবনে উবাইদ ও হাস্সান ইবনে আবী সিনান বসে আছেন। ইউনুস বললেন, আমার কাছে তাকওয়াই কষ্টকর সাধনার বিষয় মনে হয়। হাস্সান বললেন, কিন্তু আমার কাছে তাকওয়া অনেক সহজ মনে হয়। ইউনুস এ কথায় বিস্মিত হয়ে বললেন, কীভাবে? হাস্সান বললেন, সন্দেহ হলে পরিত্যাগ করি আর সন্দেহমুক্ত হলে গ্রহণ করি। এভাবে আমি আরাম পেয়ে থাকি।
হাস্সান ইবনে আবী সিনান একবার ঈদের দিন বের হয়ে গেলেন। নামায শেষ করে ফিরে এলেন। তার স্ত্রী বললেন, আজকের দিনে কত সুন্দরী নারী দেখেছেন! অনেক রমণী আপনার মন কেড়েছে! অনেক বার বিবি সাহেব একই কথা বলার পর তিনি বললেন, তোমার কাছ থেকে বের হয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত আমি কোন কিছু দেখিনি। দেখিছি তো আমার এই বুড়ো আঙ্গুলটি।
হযরত হাস্সান রহ. হযরত মালিক বিন দীনার রহ. মজলিসে হাজির হতেন। মালিক বিন দীনার কথা বললে, হাস্সান রহ. কাঁদতেন। সামনে অনেক কিছু চোখের পানিতে ভিজে যেতো। কিন্তু তার কান্নার কোন আওয়াজ ছিল না। হযরত হাস্সান ইবনে আবী সিনান রহ. বেশি বেশি দান-সদাকা করতেন। তিনি বলতেন, গরীব ও অসহায় লোকজন না থাকলে আমি (আখেরাতের এই) বিকিকিনি করতে পারতাম না।
হযরত হাস্সান ইবনে আবী সিনান রহ. বসরা শহরের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তার পার্টনার আহ্ওয়াজ এলাকায় থাকতো। তাদের মাঝে নববর্ষে সাক্ষাত হতো। তখন লাভ-লোকসান ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতো। হযরত হাস্সান রহ. লাভ থেকে নিজের আহার্য নিয়ে অবশিষ্টাংশটুকু দান করে দিতো। একবার তিনি অভ্যাস অনুযায়ী নিজের ধনসম্পদ বিলিয়ে দিলেন। বলা হল, এমন কিছু পরিবার রয়ে গেছে যাদের অভাবের কথা আগে শোনা যায়নি। তিনি দুঃখিত হলেন, বললেন, আগে বলবে না? এরপর তিনি তাদের জন্য তিনশত দিরহার ঋণ করে তাদের নিকট পাঠিয়ে দিলেন।
রয়ে গেল তার ইবাদত-বন্দেগীর কথা। এগুলো আর কী বলব! এক কথায় ইবাদত-বন্দেগী ছিল অসাধারণ। তার স্ত্রীকে বলতে দিন। তিনিই তার ইবাদত-আসক্তির কথা বলতে পারবেন। তিনি বলেন, হাস্সান ইবনে আবী সিনান রাতে অন্ধকার নামামাত্রই আমার সাথে বিছানায় শুয়ে পড়তেন। বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানির মতো এরপর আমাকে ভুলিয়ে রেখে যেতো। যখন তিনি বুঝতেন আমি ঘুমিয়ে গেছি নিঃশব্দে সটকে পড়তেন। এরপর শুরু হতো তার নামায আর নামায। আমি বললাম, আবূ আব্দুল্লাহ্! আর কত নিজেকে এমন সাধনায় দগ্ধ করবে? নিজের সুখ ও আরামের চিন্তা তো করতে হয়! একটু বিশ্রাম নাও! ছলছল নয়নে বলল, নীরবতা অবলম্বন কর। সেই দিন বেশি দূরে নয় যখন আমি এমন ঘুমে নিমজ্জিত হবো যা থেকে আবার উত্থিত হবে বেশ সময় লেগে যাবে।
সিয়াম সাধনা করতেন কোমর বেঁধে। সিয়াম সায়রে সাঁতরাতেন। সাধনার তলদেশ ছুঁয়ে যেতেন। সামান্য আহার ছিল ইফতারে আর সামান্য আহার্য ছিল সেহরীতে। এভাবে না খেয়ে থাকতে থাকতে কঙ্কালসার হয়ে পড়েন। মনে হতো কোন আবছা ছায়ামূর্তি।
হাস্সান ইবনে আবী সিনান রহ. মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তার সঙ্গীসাথীরা তাকে দেখতে আসল। তারা বলল, আমার মেজাজ কেমন? শরীর কেমন? কেমন লাগছে? কাঁপা কণ্ঠে বললেন, জাহান্নাম থেকে বাঁচতে পারলে তাহলে তো ভালোই আছি। জিজ্ঞাসা করা হল, কী চান? কোন কিছু খাওয়ার বা চাওয়ার আছ? আপনার অভিলাষ কী? তিনি বললেন, একটি অনেক দীঘল রজনী চাই। যে দীর্ঘ আমি রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করতে পারি।
ইন্তেকালের পর তাকে নেওয়া হল গোসল দেওয়ার জন্য। কাপড় সরালে মনে হল, একটি কালো সুতোর মতো। হাড়জিরজিরে এমন মানুষ নিজেকে সিয়ামের শুদ্ধতায় পরিশুদ্ধ করেছিলেন। হয়েছিলেন সফলতার মানদ-ে নিকষিত। হিজরী ১৫১ সালে তিনি মারা যান।