সুফইয়ান সাওরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৬১ হিজরী : ৭৭৮ খৃস্টাব্দ)

দুনিয়ার প্রতি নির্লিপ্ত ছিলেন। যার ফলে আল্লাহ তাআলা তাঁর অন্তরে হিকমত ও প্রজ্ঞা অঙ্কুরিত করেছেন। আখেরাতে যা অমর ও অবিনশ্বর হয়ে থাকবে দুনিয়ার জন্য তাই রেখে গেছেন। দুনিয়ায় সাঁতার কেটেছেন তবে কাপড় ভেজেনি। জাগতিক কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন; কিন্তু দুনিয়ার মোহে বিমোহিত হননি। তাকওয়ার তালা দিয়ে খায়েশ ও প্রবৃত্তির দোআর রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন।
ইলম তলব করেছেন শৈশবকালের কচি সময়ে। তারুণ্যের উঠতি সময়ে ইলম আহরিত ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। ভরাযৌবনে ইলম বিতরণ করেছেন দেদার। বিপদাপদ যার দৃষ্টিতে নেয়মত ছিল। সুখ-শান্তি ও সচ্ছলতা বিপদের কারণ মনে হতো। তিনি সুফইয়ান ইবনে সাঈদ ইবনে মাসরূক সাওরী। গোটা উম্মতের আলেম। শাইখুল ইসলাম। হাফিযে হাদীসদের প্রধান ব্যক্তিত্ব। উলামা কেরামের মধ্যমণি। হাদীসশাস্ত্রের আমীরুল মুমিনীন। ইলম, প্রজ্ঞা ও মর্যাদার গুণে যিনি সময়ের নেতৃত্বে অগ্রগামী ছিলেন।
যাঁর হৃদয়জুড়ে দুশ্চিন্তার আস্তানা ছিল। জাহান্নামভীতিতে যাঁর অন্তর কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাদশাহ মানসূর যাকে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে সমাসীন হতে প্ররোচিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। গুরু দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার লক্ষ্যে অবশেষে কুফা নগরী ছেড়ে মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফে আশ্রয় নেন। সেখানে কাটিয়েছেন জীবনের বাকি সময়টুকু। পরবর্তীতে বাদশাহ মাহদী খোঁজ করলে তিনি আত্মগোপন করেন। গা ঢাকা দিয়ে চলে আসেন বসরা নগরীতে। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এখানেই মারা যান।
আল্লাহ তাআলা তাকে অসাধারণ মেধা দিয়েছিলেন। যা ইচ্ছে তাই মুখস্থ করে নিতে পারতেন। স্মরণশক্তি থেকে কোন কিছু হারাতো না। ভীমরতি, বুদ্ধি-ভ্রষ্টতা বা স্মৃতিবিস্মৃতি হতো না। প্রতিভা সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, আমি যখনই কোন কিছু হৃদয়ে আত্মস্থ করেছি সেটা কখনও ভুলিনি। হারিয়ে যায়নি স্মৃতিপট থেকে।
তিনি ছিলেন ইলমের সমুদ্র। বিদ্যাসাগর। আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে নিন্দুকের নিন্দা নিয়ে শঙ্কিত হননি। ভাবিয়ে তুলেনি কোন ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনা। পাছে তিরস্কৃত হবেন এ নিয়ে মাথা ঘামাননি শরয়ী বিধানের বেলায়। ক্ষীণকায় এক মানুষ। হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তি। শরীফ, ভদ্র ও মুত্তাকীদের নীড় যাঁর হৃদয়কে তাকওয়ার মরূদ্যানে নিয়ে গেছে। দুনিয়ার আনন্দ-বিনোদনের সামনে খোদাভীতি যার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কুতাইবা রহ. বলেন, সাওরী না হলে তাকওয়া মরে যেতো। শু’বা রহ. বলেন, তাকওয়া ও ইলম দিয়ে সুফইয়ান সাওরী নেতৃত্ব করেছেন। শাইখ আহমাদ ইবনে ইউনুস রহ. বলেন, সুফইয়ান সাওরী অপেক্ষা বড় আলেম আমি দেখিনি। তার চেয়ে বড় মুত্তাকী, বড় ফকীহ ও দুনিয়াত্যাগী চোখে পড়েনি। সুফইয়ান সাওরী রহ.কে জিজ্ঞাসা করা হল, দুনিয়াবিরাগ ও যুহদ বলতে কী বুঝায়? বললেন, পদমর্যাদার অধঃপতন এবং ছোট আশা করা। তিনি বলেন, দুনিয়ার যুহদ বলতে মানুষের প্রতি নির্লিপ্তি বুঝায়। আর মানুষের প্রতি অনাসক্তি শুরু হবে নিজের থেকে। তিনি লোকদেরকে ওয়ায করে বলতেন, যে ব্যক্তি দুনিয়া ভালোবাসে এবং জাগতিক বিষয়ে খুশি হয় তার অন্তর থেকে আখেরাতের ভয়-ভীতি অপসারিত করা হয়। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! দুনিয়া আমাদের হাতে দাও। দুনিয়ার সংস্থান আমাদের অন্তরে কর না। তিনি আরও বলতেন, তাকওয়া দ্বীনের বুনিয়াদ এবং পারলৌকিক বিষয়ের পূর্ণতাদান।
সুফইয়ান সাওরী রহ. রাত নামলে প্রবেশ করতেন নিজের ইবাদত-কামরায়। দরজা বন্ধ করে দিতেন। বলতেন, ইলাহী! সকল প্রিয়লোক তার প্রিয়জনের সান্নিধ্যে চলে গেছে। নিভৃতে যতনে দু’জন দু’জনায়। ওহে প্রিয়তম মাবুদ! আমি তোমার সান্নিধ্যে!!
তিনি দুনিয়াকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করেছিলেন। একান্ত প্রয়োজনমাফিক দুনিয়া সংগ্রহ করেন। তিনি বলতেন, দুনিয়ার জীবনে থাকার মতো উপার্জন করি। আখেরাতের জীবন অনন্তকাল। তার জন্য যা দরকার সে হিসেবে আমল করি। হযরত সুফইয়ান সাওরীর অবস্থা সম্পর্কে শাইখ আলী বিন সাবিত বর্ণনা দিচ্ছেন, সুফইয়ান সাওরীকে মক্কা শরীফের পথে দেখিছি। তার সবকিছু আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এমনকি তার জুতোও ঠিক করে দিয়েছি। তিনি বলেছেন, মক্কা শরীফের রাস্তায় যদি তোমার সাথে সুফইয়ান সাওরীর দেখা হয়, তুমি তাকে দুই পয়সা দিতে চাও কিন্তু তুমি তাকে চিনো না মনে কর যাকে তুমি দান করবে (প্রায় নিশ্চিত) সেটা সুফইয়ান সাওরী-ই পাবে।
সুফইয়ান সাওরী রহ. বলেন, নির্মাণের ব্যাপারে আমি কখনও এক দিরহামও খরচ করিনি। আমি নিজের জন্য তিনটি বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি। তিনি কারও থেকে খেদমত গ্রহণ করবেন না। কাপড় সেলাই করবেন না। ইটের উপর ইট রাখবেন না (অর্থাৎ বাড়িঘর বানাবেন না)।
সুফইয়ান সাওরী রহ. দুনিয়া ও সম্পদ সঞ্চয়কারীদের নিয়ে উপহাস করতেন। তিনি বলতেন, দুনিয়ার নামকরণের কারণ হল, দুনিয়া মানে রদ্দি, ওঁচা ও বাজে। মাল (সম্পদ) এর নামকরণ এ জন্য যে, মাল লোকদেরকে মায়েল বা আকৃষ্ট করে।
তিনি শোহরত ও প্রচার-প্রসিদ্ধি পছন্দ করতেন না। নিজেকে জনসম্মুখে জাহির করতে লালায়িত ছিলেন না। এক লোক ওসিয়ত-নসিয়ত চেয়ে তার নিকট আসল। তিনি লোকটিকে বললেন, সুনাম-সুখ্যাতি থেকে বেঁচে থাকো। ঢোল-শোহরত এড়িয়ে চল। হযরত আলী ইবনে সাবিত বলেন, সুফইয়ান সাওরীকে কখনও মজলিসের প্রধান ভাগে বা আসনে দেখিনি। তিনি দেয়ালের পাশে হেলান দিয়ে বসতেন। হাঁটুদ্বয় মিলিয়ে রাখতেন। সুফইয়ান সাওরী রহ. আশেপাশের লোকদেরকে বলতেন, আমার মনে চায়, আমি আমার জুতো নিয়ে এমন স্থানে বসে পড়ি যেখানে আমাকে কেউ চিনে না।
এক ব্যক্তি সুফইয়ান সাওরীকে একটি কাপড় হাদিয়া দিল। তিনি সেটি গ্রহণ করলেন না। লোকটি বলল, হে আবু আব্দুল্লাহ্! আমি তো আপনার কাছে হাদিস শুনেনি। শোনে থাকলে গ্রহণ না করার বিষয়টি গ্রাহ্যতা লাভ করতো। সুফইয়ান সাওরী রহ. বললেন, তুমি যে আমার থেকে হাদীস শোনেনি তা আমি বিলক্ষণ জানি। তুমি না শুনলে কি হবে; তোমার ভাই তো শুনেছে। তাই আশঙ্কা হয় যদি তোমার হাদিয়া গ্রহণ করি এতে অন্যদের চেয়ে তোমার ভাইয়ের প্রতি আমি দয়াপরবশ হয়ে যাবো।
একদিন তিনি বিশিষ্টজন নিয়ে বসে আছেন। নিজের গুনাহের কথা তাদের নিকট অভিযোগের সুরে শোনাচ্ছেন। শুধুমাত্র একটি গুনাহের কারণে পাঁচ মাসের রোযা ও রাতের ইবাদত-বন্দেগী থেকে বঞ্চিত হয়েছি। প্রশ্ন করা হল, সে কোন্ গুনাহ। বললেন, এক ব্যক্তিকে মসজিদে কাঁদতে দেখলাম। মনে মনে বললাম, রিয়াকারী, লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সে কাঁদছে।
একদিন তিনি মুদ্রা ভাঙানোর উদ্দেশ্যে ‘মানি এক্সচেঞ্জার’ নিকট গেলেন। হঠাৎ তার হাত থেকে এক দীনার মুদ্রা পড়ে গেল। খোঁজ করে পেয়ে গেলেন। তবে দেখলেন, হারানো দীনারটির পাশে আরেকটি দীনার পড়ে আছে। তিনি নিজের মুদ্রাটি পড়ে থাকা মুদ্রা থেকে আলাদা করতে পারলেন না বিধায় তিনি তাকওয়ার খাতিরে হারানো মুদ্রাটি গ্রহণ করলেন না।
বাদশাহ মাহদী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি সুফইয়ান সাওরীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি গেলেন, রাজদরবারে। আমীরুল মুমিনীন তার আংটিটি খুলে সুফইয়ান সাওরীর দিকে ছুড়ে মারলেন। বললেন, আবূ আব্দুল্লাহ্, এটা আমার আংটি। এই উম্মতের জন্য কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে আমলের ব্যবস্থা করুন। সুফইয়ান সাওরী রহ. বাদশাহ’র নিকট নিরাপত্তা চাইলেন। বাদশাহ তাকে নিরাপত্তা দিলেন। সুফইয়ান সাওরী বললেন, আমীরুল মুমিনীন, আমি নিজেই আপনার দরবারে আসবো। আমাকে আসার জন্য লোক পাঠাবেন না। আপনার কাছে কোন কিছু না চাইলে আমাকে কোন কিছু হাদিয়া দিবেন না। এ কথা বলে বের হয়ে গেলেন। মাহদী কিছুটা মর্মাহত হলে। রাগ করলেন। চাইলেন তার এক হাত দেখিয়ে দিতে। কিন্তু সচিব (কেরানি) বলল, আমীরুল মুমিনীন, আপনি তো তাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।
মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম হাশেমী রহ. সুফইয়ান সাওরীর নিকট দুইশত দীনার পাঠালেন। তিনি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। জিজ্ঞাসা করা হল, বললেন, নিজেকে অন্যের কাছে অপদস্থ করতে লজ্জা লাগে। একরাতে সুফইয়ান সাওরী রহ. পায়ে হেঁটে চলছেন। এ সময় দূর থেকে আগুন দেখলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী? বলা হল, পুলিশ সুপারের আগুন। বললেন, চলো আমরা অন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটি। কারণ এ রাস্তা দিয়ে গেলে তাদের আগুনে আমাদের আলোকিত হতে হবে।
একদিন সুফইয়ান সাওরী রহ. বলা হল, যদি আপনি আমীরদের নিকট যেতেন!! তিনি বললেন, আমার ভয় হয় যদি আল্লাহ তাআলা আমাকে আমার অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। একবার তাকে বলা হল, স্মৃতি থেকে কিছু কথা সহীহভাবে বলুন। তিনি বললেন, কাপড় না ভিজিয়ে সমুদ্রে সাঁতার কাটার কথা বলছো!
খোদাভীতি ও তাঁর মাহাত্ম্য তার হৃদয়জুড়ে বিদ্যমান ছিল। যার ফলে তিনি চড়াইপাখির ন্যায় কাঁপতে থাকতেন। দু’চোখের পানি কখনও শুকাতো না। রোনাজারি করতেন। চাপা কান্নায় গুনগুন করতেন।
আতা খাফ্ফাফ রহ. বলেন, সুফইয়ান সাওরীকে যখনই দেখিছি ততবারই তাকে কাঁদতে দেখিছি। আমি তাকে বললাম, কী অবস্থা? তখনও সুফইয়ান সাওরীর চোখের জলে নয়ন ভাসছে। বললেন, আমার আশঙ্কা না জানি লওহে মাহফুয বা সংরক্ষিত ফলকে আমি হতভাগা হিসেবে চিহ্নিত!! (পরকালে হতভাগা বলতে ঈমানহারা বুঝায়)। সুফইয়ান সাওরী রহ. রাতে যখন ঘুমাতেন হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে যেতেন। চেঁচিয়ে বলতেন, আগুন! আগুন! জাহান্নামের আগুনের কথা মনে পড়লে আমার ঘুম আর মনচাওয়া কোন কিছু হারাম হয়ে যায়।
এক ব্যক্তি সুফইয়ান সাওরীকে অনুসরণ করতো। সবসময় তিনি তাকে দেখতেন, তিনি একটি বাগান থেকে বের হতেন। সেখানে একটি চিরকুটের লিখা তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়ে আবার আপন জায়গায় রেখে দিতেন। লোকটি জানতে চাইলো, চিরকুটে কী লিখা রয়েছে। দেখে তাতে লিখা আছে, সুফইয়ান, সাবধান!! তোমার উপর আল্লাহ তাআলা রয়েছেন।
আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী হযরত সুফইয়ান সাওরীর মৃত্যুবরণের ঘটনা জানাচ্ছেন। তিনি বলেন, সুফইয়ান সাওরী আমার নিকট মারা গিয়েছেন। মৃত্যুযন্ত্রণা বেড়ে গেলে কাঁদতে লাগেন। এক ব্যক্তি বলল, হে আবূ আব্দুল্লাহ্! আপনাকে অনেক বড় গুনাহগার মনে হচ্ছে? সুফইয়ান সাওরী মাটি থেকে একটি কিছু উঠিয়ে বললেন, আমার পাপরাশি এই সামান্য জিনিস থেকে তুচ্ছ। (অর্থাৎ আমি গুনাহ নিয়ে ভাবি না)। আমার চিন্তা ও উদ্বেগের বিষয় হল, না জানি মৃত্যুর আগে আমার ঈমান ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আমি ঈমানহারা হয়ে যাই। হিজরী ১৬১ সালে তিনি মারা যান। আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে চলে গেলেন। হাম্মাদ ইবনে যায়েদ তার নিকট গেলেন। তিনি তখন খাটিয়ার উপর কাপড়আবৃত। বলল, সুফইয়ান! আজ তোমার অধিক হাদীস বর্ণনার জন্য আমার ঈর্ষা নয়। ঈর্ষা হয় তো তোমার আমলের দরুন। জীবনে তুমি অভাবনীয় আমল করে আখেরাত গুছিয়েছো। সেটা মূলত ঈর্ষণীয়।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it