সালমান ফারসী রাযিআল্লাহু আনহু (মৃ. ৩৬ হিজরী : ৬৫৬ খৃস্টাব্দ)
সালমান আমাদের বংশের। ইসলামের মেহরাব থেকে ইতিহাস গড়া এক ব্যক্তি। এক মাবুদ, আসল বাস্তবতার সন্ধানে বের হয়ে খোঁজে পাননি বাইবেলে। ইঞ্জিল ও তাওরাতে সত্যের নির্যাস না পেয়ে খুঁজতে থাকেন সত্যের সন্ধানে। অবশেষে সেই সত্য, মহামাবুদের খোঁজ পান ইসলামে। ঈমানের চেরাগে আল্লাহ তাআলা যাঁর হৃদয়কে আলোকিত করেছিলেন।
তিনি সালমান রা.। যিনি নিজেকে সালমানুল ইসলাম বলতেন। ‘আসবাহান’ এলাকার অগ্নিপূজারী বংশের লোক ছিলেন। ‘যিয়ান’ লোকালয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। সফর করেছিলেন সিরিয়া, মুসিল, নসীবাঈন, আমূরিয়া। অগ্নিপূজারী, ইয়াহূদী ও নাসারাদের ধর্মগ্রন্থ পড়েছিলেন। যখন শুনতে পেলেন যে, শেষ যামানার শেষ নবীর আগমনের ঊষা অত্যাসন্ন, তিনি প্রেরিত হবেন আরব উপদ্বীপে, তখন তিনি আরব ভূখণ্ডের দিকে সফরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে দেখা হয় বনী কালাবের সাথে। তারা হযরত সালমান রা.-কে কাজের লোক হিসেবে ব্যবহার করে এবং অবশেষে ক্রীতদাসে পরিণত করে বিক্রি করে দেয়। (মদীনার) বনু কুরাইযা গোত্রের জনৈক ব্যক্তি হযরত সালমান রা.-কে ক্রয় করে মদীনায় নিয়ে আসে।
মদীনায় মহানবী ﷺ-এর আগমনের সংবাদ শোনে তিনি তাঁর দরবারে আসলেন। নবুওতের বিভিন্ন নিদর্শন দেখে মহানবী ﷺ-এর পদতলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মুসলমান হলেন। ইসলাম গ্রহণের বিষয়টা গোপন রাখলেন। নিজের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে দাসত্বের নিগড় হতে মুক্ত হতে চাইলেন না। বদর ও উহূদ প্রান্তরে মুসলমানদের সাথে সমর অভিযানে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি তাঁর মনিব। অবশেষে নিজের গোলামি থেকে মুক্ত হতে তাঁকে মুসলমানগণ সহায়তা করলেন। ইসলামের বিষয়টি জাহির করলেন। আহযাব ও পরিখা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং পরিখা খননের পরামর্শ তিনিই প্রদান করেছিলেন।
সর্বদা নবীজী ﷺ-এর দরবারে পড়ে থাকতেন। তাঁর খেদমত করতেন। মুসলমান কর্তৃক ইরাকে সমর অভিযান পরিচালনা করার আগ পর্যন্ত তিনি মদীনায় অবস্থান করেছিলেন। মাদায়েন বিজয়ের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। হযরত উমর রা. তাঁকে মাদায়েনের শাসক নিযুক্ত করেন। তিনি আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন। কিসরা প্রাসাদ সংলগ্ন তাঁর সমাধি অতি পরিচিত।
তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান, চৌকস, শক্তিশালী, বুযূর্গ, পরহেযগার। সাদামাঠা জীবন যাপন করতেন। গাধায় চড়তেন। শাসক থাকা অবস্থায় বাচ্চাদের নিয়ে হাসি-কৌতুক করতেন। প্রার্থিব ভালোবাসা তাঁর হৃদয়কে নিগড়িত করতে পারেনি। প্রবৃত্তি দুষ্টমি তাঁর অন্তর থেকে বিতাড়িত ছিল। মুহাজির ও আনসার সবাই হযরত সালমান রা. নিয়ে নিজেদের হৃদয়গ্রাহিতা দেখাতেন। মুহাজির সাহাবা কেরাম বলতেন, সালমান আমাদের। আনসার সাহাবা কেরাম বলতেন, সালমান আমাদের বংশোদ্ভূত। মহানবী ﷺ সালমান রা. এর সম্পর্কে বলতেন, সালমান আমাদের পরিবারের একজন সদস্য। জনৈক ব্যক্তি সালমান রা.-কে বললেন, আপনার বংশ কী? তিনি বললেন, ইসলাম ছাড়া আমার আর কোন বংশীয় পরিচয় নেই। হযরত আবুদ্দরদা রা. বলেন, নবীজী ﷺ আর সালমান রা. এক সাথে মিলিত হলে মহানবী ﷺ আর কাউকে খোঁজতেন না।
হযরত সালমান রা.-কে প্রশ্ন করা হল, নেতৃত্বের কোন বিষয়টা আপনার অপছন্দ? তিনি বললেন, দুগ্ধ পানের মজা আর দুগ্ধ ছাড়ানোর তিক্ততা। একবার হযরত সালমান রা. কুরাইশী আসরের পাশ যাচ্ছিলেন। তাঁকে জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো, তোমার বংশ কী? পিতৃ পরিচয় কী? কুরাইশী আসরে তোমার আনাগোনা কেন? হযরত সালমান রা. কাঁদলেন। আবেগভরা কণ্ঠে বললেন, আমার বংশ ও গোত্র নিয়ে তোমার প্রশ্ন! আমি তো সামান্য নাপাক শুক্রাণু থেকে সৃজিত। এখন তো (আখেরাতের) ভাবনা এবং চোখের পানি। আগামী দিন দুর্গন্ধ গলিত লাশ। (কেয়ামত দিবসে) যখন আমলনামা খোলা হবে, আমলের নিক্তি স্থাপন করা হবে, ন্যায়ের নিক্তির ভিত্তিতে চূড়ান্ত বিচারের জন্য লোকজনকে ডাকা হবে সেদিন আমার আমলের পাল্লা যদি ভারী হয়ে যায় তাহলে তো আমি সেদিন শরীফ ও খান্দানী। আর যদি আমলের পাল্লায় ন্যূনতা ও ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে তো আমি অকুলীন ও লাঞ্ছিত। এটা আমার বংশীয় পরিচয় এবং সকল মানুষেরও গোত্র পরিচয়।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. তাঁর দ্বীনি ভাই হযরত সালমান ফারসী রা.-কে দেখার জন্য উদ্-গ্রীব হলেন। তিনি তাঁকে ডেকে পাঠালেন। সাক্ষাত হওয়ামাত্রই তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং পরস্পর কোলাকুলি করলেন। এরপর হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. জিজ্ঞেস করলেন, আমার ব্যাপারে কোন অভিযোগ আছে কিনা? তিনি বললেন, জানতে পারলাম আপনি চর্বি ও গোস্ত খান। দু’টি জামা পরিধান করেন। বাসায় একটি আর বাইরের পরিবেশে অন্যটি। হযরত উমর রা. বললেন, আর কোন অভিযোগ? তিনি বললেন, না, আর কোন অভিযোগ নেই। হযরত উমর রা. বললেন, এমন আহার করবো না এবং এমন পরিধেয় বস্ত্র পরিধান করবো না।
আখেরাতের গুপ্ত ভাণ্ডার তথা অন্তহীন সুখের আশায় তিনি জাগতিক দিরহাম ও রৌপ্যমুদ্রা খরচ করতেন। তাঁর ভাতা ছিল মাত্র পাঁচ হাজার দিরহাম। ত্রিশ হাজারের চেয়ে বেশি মুসলমানদের শাসক ছিলেন। মানুষের মাঝে তিনি আবা তথা বড় আলখেল্লা পরিধান করে কথা বলতেন। সেই আবা’র এক অংশ বিছাতেন অবশিষ্টাংশ পরিধান করতেন। ভাতা পেয়ে দস্তখত করে সেগুলো দান করে দিতেন। তিনি নিজের উপার্জন থেকে আহার্য গ্রহণ করতেন। এক দিরহাম দিয়ে খেজুরের পাতা কিনে তাতে উপযোগ সৃষ্টি করতেন এবং ব্যবহারের যোগ্য করে তিন দিরহাম বিক্রি করতেন। সেখান থেকে এক দিরহাম দিয়ে আবার পাতা কিনতেন। এক দিরহাম নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করতেন। এক দিরহাম দান করতেন। তিনি বলতেন, হযরত উমর রা. যদি আমাকে এ কাজ করতে বারণ করে আমি নিবৃত্ত হবো না।
মাদায়েন শহরে হযরত সালমান ফারসী রা.-এর কোন বাড়িঘর ছিল না। অথচ তিনি সেখানকার আমীর ও শাসক। যেখানে যেতেন সেখানকার সামান্য ছায়া বা ছাউনিই তাঁর আশ্রয়স্থল। এক ব্যক্তি বলল, আপনার জন্য একটি ঘর তৈরি করে দিবো, যেখানে আপনি একটু বিশ্রাম নিতে পারেন। এতে শীত ও গরমে আরামে থাকতে পারবেন। হযরত সালমান ফারসী রা. দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে আকুলতা প্রকাশ করলেন, হাঁ! দরকার তো বটে! তবে তুমি বলো, কেমন ঘর বানাতে চাও? লোকটি বলল, বাঁশের তৈরি ঘরটি হবে খুব নিচু। দাঁড়ালে মাথা লাগবে ছাদে এবং শুইতে গেলে দেয়ালে পা ঠেকে যাবে। লোকটির বর্ণনা শোনে তিনি মাথা নেড়ে বললেন, হতে পারে। বর্ণনানুসারে নির্মিত হল বাঁশের ঝুপড়ি।
একবার গরমের মওসুমে তিনি মোটা পশমের জুব্বা পরিধান করে বের হলেন। জনৈক লোক বলে উঠল, এর চেয়ে কোমল জামা যদি পরতেন তাহলে ভালো হতো। হযরত সালমান রা. মাথা ঝুঁকালেন এবং বিনীত হয়ে বললেন, আমি তো শুধুই একজন দাস। গোলাম যা পরিধান করে আমিও তা পরিধান করি। মৃত্যুর পরে এমন জুব্বা গায়ে দিবো যার আঁচল কখনও জীর্ণ হবে না, ক্ষয় হবে না ব্যবহারে। হযরত সালমান ফারসী রা. সংবেদনশীল মনের অধিকারী ছিলেন। হৃদয়জুড়ে ছিল প্রাণপ্রাচুর্য। কেঁদে কেঁদে বলতেন, তিনটি বিষয় আমাকে তাক লাগিয়েছে। সেগুলো চিন্তা করে আমি হাসি। (ক) দুনিয়ার আশাবাদী (ব্যক্তি)। অথচ মৃত্যু তাকে খোঁজে। (খ) উদাসীন লোক। অথচ তাকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। (গ) মুখভরে হাস্যকারী। অথচ সে জানে না যে, জগতের প্রতিপালক তার প্রতি রাজি না নারাজ। পক্ষান্তরে তিনটি জিনিস আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এতে আমি কাঁদি। (ক) মুহাম্মাদ ﷺ, তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও সাহাবা কেরামের বিরহ। (খ) কেয়ামতের ভয়াবহতা। (গ) আমার প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানো। আমার জানা নেই যে, (তখন) আমার ব্যাপারে কি জান্নাতে যাওয়ার ঘোষণা আসে না জাহান্নামে যাওয়ার ঘোষণা করা হয়।
হযরত সালমান রা. মৃত্যুশয্যায় শায়িত। দেখতে আসলেন হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.। তিনি যখন তাঁর নিকট বসলেন সালমান রা. কাঁদলেন। গণ্ডদেশ বেয়ে চোখের পানি বেয়ে পড়ল। হযরত সা’দ রা. বললেন, আপনি কেন কাঁদছেন? নবীজী ﷺ দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার সময় তো আপনার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন এবং আগামী দিনেও (আল্লাহ চায় তো) নবীজীর সাথে হাউজে কাউসারে আপনার সাক্ষাত হবে। (সুতরাং এমন সফল জীবনাবসানে কান্নার কী আছে?) হযরত সালমান রা. বললেন, শোনেন! মৃত্যুভয়ে আমি কাঁদছি না এবং দুনিয়া নিয়েও লালায়িত নই। তবে রাসূলে আকরাম ﷺ আমাকে একটা কথা লালন করতে বলে গিয়েছিলেন। আমার মনে হয় আমি সেটা লালন করিনি। তিনি বলেছিলেন, (অনুবাদ) তোমাদের পার্থিব সামগ্রী আরোহীর পাথেয়ের ন্যায় সামান্য হওয়া চাই। একথা বলে আবার কাঁদলেন। (পাশে রাখা ছিল গামলা, দাঁতন এবং কাপড় ধোয়ার পাত্র। যেগুলো এক জন মানুষের জন্য অতি নগণ্য সামগ্রী। কিন্তু তিনি সেগুলোকে অনেক বেশি মনে করে কাঁদতেন।)
হযরত সা’দ রা. তাঁকে বললেন, আপনি আমাকে উপদেশ দান করুন। আপনি চলে গেলে আমি তা পালন করবো। তিনি বললেন, টেনশনে পড়লে আল্লাহ তাআলার যিকির করুন। সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় আল্লাহকে স্মরণ করুন। ভাগ-বাটোয়ারা করার সময় আল্লাহ তাআলার ধ্যানে থাকুন। হিজরী ৩৬ সালে তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। জনশ্রুতি রয়েছে যে, হযরত সালমান রা. এর রেখে যাওয়া সম্পত্তির পরিমাণ ত্রিশ দিরহামের কম মূল্যমানের ছিল। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি খুশি থাকুন এবং আল্লাহ তাঁকে খুশি করে দিন।