মাসরূক ইবনুল আজদা’ رحمة الله عليه (মৃ. ৬৩ হিজরী : ৬৮২ খৃস্টাব্দ)
সেজদা অবস্থায় ঘুমাতেন। সেজদাবনত ব্যতীত যিনি কখনও ঘুমাননি। খোদাভীতির দোআরে দোআরে ঘুরে বেরিয়েছেন। রাতের আঁধারে যিনি একজন সত্যিকার রাহিব এবং মুত্তাকী লোক। আদর্শ ও অনুকরণীয় ব্যক্তি। নির্ভরযোগ্য তাবেঈ। আরিফ বিল্লাহ্। মাবুদের সাথে যাঁর গভীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সংবেদনশীল মনের অধিকারী। তিনি আবূ আইশা মাসরূক ইবনে আব্দুর রহমান আলহামাদানী। ইয়েমেন বংশোদ্ভূত। মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে শৈশবে তিনি পাচার হওয়ার কারণে তাকে মাসরূক বা পাচারকৃত বলা হয়। মহানবী ﷺ-এর যুগে তিনি মুসলমান হয়েছিলেন। তিনি ইসলামী ও জাহিলী যুগের ‘মুখাযরিম’ বা কালের সাক্ষী মুসলমান। হযরত আবূ বকর রা. এর শাসনামলে মদীনায় আগমন করেছিলেন। পরবর্তীতে কুফা নগরীতে বসবাস করেছিলেন। সাদামাঠা জীবনযাপন করতেন। ইলম ও আমলের ময়দান ব্যতীত অন্য কোথাও তিনি থাকতেন না।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর সাথে মাসরূকের সাক্ষাত হয়েছিল। উমর ফারূক রা. জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার নাম কি? তিনি বললেন, মাসরূক ইবনুল আজদা’। হযরত উমর রা. বললেন, আলআজদা’ তো শয়তানের নাম। তুমি মাসরূক ইবনে আব্দুর রহমান। পরবর্তীতে তিনি এই নামেই পরিচিত হয়েছিলেন। বিচারপতি শুরাই’র চেয়ে বেশি ফাতাওয়ার ব্যাপারে জ্ঞান রাখতেন। নামায পড়তে লাগলে মনে হতো রাতের নির্জন কক্ষে তিনি একজন রাহিব। দুনিয়া বিরাগী একজন মুসল্লী। কাদেসিয়া যুদ্ধের দিন তাঁর হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। জনশ্রুতি আছে যে, হামাদান এলাকায় মাসরূকের ন্যায় কোন মুসলিম মনীষী জন্মগ্রহণ করেনি।
একবার উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদ কুফা নগরীতে এসে বলল, মানুষের মাঝে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি কে? লোকজন বলল, মাসরূক। বিখ্যাত এই আলেমে দ্বীন সর্বদা ইলম ও জ্ঞানের জন্য সাধনা করেছিলেন। সফরে কাটিয়েছেন জীবনের বহু সময়। ইলম ও জ্ঞানের আসরে যাতায়াত করতেন সর্বদা। মুহাদ্দিসদের সাথে উঠাবসা করতেন। ইমাম শা’বী রহ. বলেন, বিশ্বজোড়া মাসরূকের চেয়ে অন্য কাউকে বেশি ইলমের জন্য অনুসন্ধিৎসু কোন তালিবুল ইলম আমি দেখিনি।
একদিন তিনি কুফা নগরী থেকে বের হয়ে বসরা অভিমুখে চললেন। উদ্দেশ্যে একজন লোকের সাথে সাক্ষাত করবেন এবং তাকে একটি কুরআনের আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেই লোকটির নিকট উক্ত আয়াতটির ইলম পেলেন না। পরে জানতে পারলেন যে, এই আয়াতের ইলম অন্য এক লোকের নিকট আছে। সে সিরিয়ায় থাকে। তিনি সিরিয়া অভিমুখে চললেন।
যুহদ ও তাকওয়া সম্পর্কে তাঁর শিক্ষণীয় ঘটনাবলী বর্ণিত রয়েছে। যেসব ঘটনা শোনে বিস্মিত হতে হয়। একবার তিনি হজ্জ্ব করতে গেলেন। সেজদা অবস্থায় সামান্য ঘুম ব্যতীত তিনি আর ঘুমাননি। হজ্জ্ব শেষে বাড়ি ফেরার পর তিনি শুয়েছিলেন। তাঁর বিবির বর্ণনা, তিনি নামায পড়তে পড়তে পদযুগল ফুলে যেতো। বিচারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু বিচার করে কখনও পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন না। তিনি বলতেন, আল্লাহ তাআলা মুমিনদের থেকে তাদের জান-মাল জান্নাত দেওয়ার বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন। তিনি বলতেন, যখন কাজের লোক বলে, বাড়িতে কোন আটাও নেই কোনও দিরহামও নেই-তখন আমার বিশ্বাসের পরীক্ষা হয়ে যায়।
একবার তিনি এক খচ্চরে চড়লেন। পেছনে বসালেন তাঁর এক ভাতিজাকে। তিনি তাকে বললেন, তোমাকে দুনিয়া দেখাবো? একথা বলে তিনি চলতে চলতে এগিয়ে গেলেন। সামনে হিরা নামক স্থানে পুরনো একটি ডাস্টবিনের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, এটাই দুনিয়া। লোকজন খেয়ে শেষ করেছে। পরিধান করে জীর্ণ করেছে।
গরমের মওসুম। তিনি রোযাদার। এ সময় হঠাৎ মাসরূক রহ. বেহঁশ হয়ে পড়লেন। তাঁর মেয়ে বলল, বাবা রোযা ভেঙে ফেলুন। বললেন, তুমি কী চাও? বলল, আপনার আরাম ও আসানি। বললেন, মেয়ে, আমি তো নিজের জন্য সে দিন আসানি ও সহজতা চাই যে দিনের দৈর্ঘ্য হবে পঞ্চাশ হাজার বছর। এরপর তিনি বলতে লাগলেন, খোদাভীতিই মানুষের ইলমের জন্য যথেষ্ট। আর নিজের আমলের প্রতি সন্তোষ মানুষের অজ্ঞতার জন্য যথেষ্ট।
তাঁর বিবি বর্ণনা দিচ্ছেন যে, সব সময় দেখা গেছে যে, দীর্ঘ সময় নামাযে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তাঁর পদযুগল ফুলে আছে। মুমূর্ষু অবস্থায় কাঁদলেন। কীসের জন্য হা-হুতাশ? জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল। বললেন, হা-হুতাশ করার কী আছে? তবে এই মুহূর্তটি কঠিন। জানি না আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে। আমার সামনে দু’টি রাস্তা। জানি না জান্নাতের দিকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে নাকি জাহান্নামের দিকে। দুনিয়া থেকে খালি হাতে চলে গেলেন। যেভাবে দুনিয়ায় খালি হাতে এসেছিলেন ঠিক তেমনিভাবে দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। কানাকড়িরও মালিক ছিলেন না তিনি। যখন তিনি আখেরাতের সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন তাঁর স্বজনেরা কাফনের মূল্য খোঁজেও পাননি। তারা কাফনের মূল্য করজ নিয়েছিলেন। হিজরী ৬৩ সালে কুফা নগরীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।