ওয়াকী’ ইবনুল র্জারাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৯৭ হিজরী : ৮১২ খৃস্টাব্দ)
নিজেকে নিকষিত করেছেন। পরিশীলিত করেছেন। হয়েছেন পরিশুদ্ধ। হয়েছেন অসাধারণ গুণে বিশেষিত। স্থায়ী দুশ্চিন্তা দিয়ে যিনি হৃদয় আলো লাভ করেছেন। আনুগত্য সাধনায় যিনি হয়েছেন মার্জিত। দুনিয়া যাঁর নিকট কিছুক্ষণ থাকার জায়গা। এখানের সকল সম্পর্ক বিরহের নিগড়ে নিগড়িত। বেঁচেবর্তে ছিলেন। দিন এনে দিন খায় জীবন যাপন করতেন। মোটা খেতেন এবং স্থূল পরিধান করতেন। তিনি আবূ সুফইয়ান ওয়াকী’ ইবনুল র্জারাহ রুয়াসী রহ.।
সময়ের মুসলিম নেতা। হাফিযে হাদীস। নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী। ইরাকের বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ। জন্মস্থান কুফা নগরীতে । বাবা সরকারী কোষাগারের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ইলমের খোঁজে দেশ বিদেশ ঘুরেছেন। ফিকহের জন্য বিদেশ-বিভুঁই থেকেছেন। হয়েছেনও বিদ্যাসাগর। সিয়ামসাধনা বেশি করতেন। রোযা রাখতেন বেশি বেশি। দিবারাত্রিতে কুরআন খতম দিতেন। মাথার উপর রাজ্যের দুঃখ-দুর্দশা বহন করতো। বাস করতেন রকমারি চাপ নিয়ে। থাকতেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
সুফইয়ান সাওরী রহ. মারা যাওয়ার পর হযরত ওয়াকী’ রহ. তার স্থলাভিষিক্ত হন। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. তাকে খুব সম্মান-সমীহ করতেন। হাদীসে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি খুব আদবকেতা ছিলেন। কিবলামুখী হয়ে হাদীস শরীফ বর্ণনা করতেন। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন, কেউ হযরত ওয়াকী’ রহ.কে দেখলে তার মনে হবে এমন মানুষ সে আর কখনও দেখেনি। তিনি বলেন, আমার দু’চোখও এমন মানুষ আর দেখেনি।
মারওয়ান বলেন, দেখা মানুষের মধ্যে ওয়াকী’র চেয়ে বিনয়ী আর কাউকে দেখিনি। যত মানুষের যত গুণের কথা আমাকে বলা হয়েছে বাস্তবে তার সেই গুণ পরিমাণে কম পেয়েছি। পক্ষান্তরে, ওয়াকী’ রহ.। তার বিশেষণ যেভাবে আমার নিকট বিবৃত হয়েছে বাস্তবে তিনি তার চেয়ে বেশি বিশেষিত ছিলেন। ইয়াহইয়া বিন মাঈন রহ.বলেন, ওয়াকী’ রহ. ছাড়া অন্য কাউকে শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য হাদীস বর্ণনা করতে দেখিনি। (অর্থাৎ তিনিই কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, জাগতিক কোন লক্ষ্য ছাড়া হাদীস রেওয়ায়েত করে থাকেন)। তিনি বলতেন, দুনিয়া মৃত প্রাণীর মতো। তোমার বেঁচে থাকার তাগিদে প্রয়োজনটুকু সংগ্রহ করে নাও।
সালিম বিন জিনাদাহ বলেন, ইয়াকী’ ইবনুল র্জারাহ রহ. এর সংস্পর্শে সাত বছর ছিলাম। সবসময় কিবলামুখী দেখতাম। কখনও আল্লাহ তাআলার নামে কসম খেতে দেখিনি। হযরত আলী ইবনে খাশরাম বিবরণ দিচ্ছেন, ওয়াকী’ রহ.এর হাতে কখনও কোন কিতাব দেখিনি। সবসময় মুখস্থ হাদীস বর্ণনা করতেন। আমি তাকে মুখস্থের উপকরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, স্মৃতিশক্তি বাড়ানো এবং ধরে রাখার একটা দাওয়া আছে তোমাকে শেখালে তুমি সেটা ব্যবহার করবে? আমি বললাম, কসম, অবশ্যই। তিনি বললেন, গুনাহ ছেড়ে দেওয়া। মুখস্থ ও স্মৃতিশক্তির জন্য পাপত্যাগের মতো কোন দাওয়া আমার অভিজ্ঞতায় নেই।
বাদশাহ হারূনুর রশীদ হযরত ওয়াকী’কে ডেকে পাঠালেন। তিনি আসলেন। বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার এলাকার লোকেরা আমার কাছে একজন বিচারক চেয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, আপনি আমার আমানতে শরীক হন। আমার ভালো ও নেক কাজে অংশগ্রহণ করুন। এই দায়িত্বটা নিন। হযরত ওয়াকী’ রহ. বিচারকার্যের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভের উদ্দেশ্যে বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আমি একনজ বুড়ো মানুষ। একচোখ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে আরেকটি হারিয়ে যাওয়ার পথে।
এক ব্যক্তি হযরত ওয়াকী’ রহ.কে কড়া কথা বলল। তিনি ঘরে প্রবেশ করে চেহারায় মাটি মাখলেন। এরপর গেলেন নিন্দুক লোকটির নিকট। অশ্রুসজল নয়নে বললেন, ওয়াকী’ এর গুনাহ অনেক। তাকে তুমি আরও কটু কথা বলতে পার। সেটা না হলে তুমি তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতে না।
ওয়াকী’ রহ. এর প্রাণ ওষ্ঠাগত। মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তার ছেলে এসে হাজির। হযরত ওয়াকী’ হাত বের করলেন। বললেন, বৎস! আমার এই হাত দেখতে পাও? এই হাতে কখনও কাউকে আঘাত করিনি। মক্কা শরীফ এবং কুফা নগরী মাঝামাঝি ফাইদ নামক স্থানে মারা যান। তখন তিনি হজ্জ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। হিজরী ১৯৭ সালে তার জীবনাবসান হয়।