ইয়াযিদ র্আরাকাশী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১২০ হিজরী : ৭৩৭ খৃস্টাব্দ)

চোখের পানি দিয়ে ধুয়েছিলেন হৃদয়ের লেলিহান আগুন। আল্লাহ তাআলার ভয়ে যিনি কেঁদে কেঁদে তাঁর ইবাদত করেছিলেন। যাঁর রোনাজারিই ছিল ইবাদতের মূল কথা। মাওলায়ে পাক আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ। হৃদয়ের পরিশুদ্ধতার জন্য জঠরজ্বালায় ভুগেছেন। তিনি ইয়াযিদ ইবনে আবান আররাকাশী। নেক ও মহৎ, বুযূর্গ ও দুনিয়াবিমুখ। রাতের শেষ প্রহরে যিনি কাঁদতেন অঝরে। মহান আল্লাহ তাআলার ভয়ে কেঁদে কেঁদে চোখের পাতা ঝরে গিয়েছিল যাঁর। চোখের পানি পড়তে পড়তে শুকিয়ে গিয়েছিল যে মহান ব্যক্তির।

দুনিয়ার প্রতি বিমুখ ছিলেন। নিজের খেয়াল-খুশি পরিহার করে চলেছিলেন। নির্জনে বসে বসে কাঁদতেন। লোকজনকে তিনি পানাহারে পরিমিত হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করতেন। তিনি বলতেন, আল্লাহ তাআলার জন্য যারা ক্ষুধার্ত কেয়ামত দিবসে তারাই প্রথম সারির জান্নাতী।

শাইখ মূসা লুকাইতী রহ. আহার সম্পর্কে ইয়াযীদের চরিত্রের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, ইয়াযীদ রাকাশী ষাট বছর যাবৎ আল্লাহ তাআলার জন্য নিজেকে ক্ষুধার্ত রেখেছে। এক পর্যায়ে তাঁর শরীর ক্ষীণকায় হয়ে যায়, শরীর ভেঙে পড়ে এবং গায়ের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এসব কিছু সত্ত্বেও তিনি বলতেন, আমার উদর আমার চেয়ে প্রবল। কোন কৌশলেই আমি তা উতরে ওঠতে পারছি না।

একবার আশআ’ব ইবনে সেওয়ার প্রচণ্ড গরমের সময় ইয়াযীদ রাকাশীর কাছে গেলেন। তিনি বললেন, আশআ’ব, চলো আমরা তৃষ্ণার এই দিনে ঠাণ্ডা পানির জন্য কাঁদি। এ কথা বলে মাথা ঝুঁকিয়ে নিজেকে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। ইবাদতগুজার লোকেরা আমাকে ছাড়িয়ে গেছেন। হায় আফসোস! আমার কী হবে! তিনি বেয়াল্লিশ বছর ধরে রোযা রেখেছিলেন। ইয়াযীদ রাকাশী বাড়িতে প্রবেশ করে কাঁদতেন। জানাযায় হাজির হয়ে কাঁদতেন। সঙ্গী-সাথীদের সাথে বসে কাঁদতেন এবং তাদেরকে কাঁদাতেন।

একদিন তাঁর ছেলে বলল, বাবা! আর কত কাঁদবে? আল্লাহ’র কসম, যদি জাহান্নাম তোমার জন্য তৈরী করা হতো তারপরও তুমি এরচেয়ে বেশি কাঁদতে না। ইয়াযীদ রাকাশী বললেন, তখনও তার গণ্ডদেশ বেয়ে চোখের পানি ঝরছে, বাছাধন, তুমি কী বুঝবে!? জাহান্নাম তো আমার জন্য এবং আমার বন্ধু-বান্ধবদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে মানুষ ও জ্বিন থাকবে। তারাও তো আমাদের ভাই। এই আয়াতটি পড়, (অনুবাদ) ‘তারা জাহান্নামের অগ্নি ও ফুটন্ত পানির মধ্যে ছুটোছুটি করবে।’ (সূরা র্আরাহ্মান, আয়াত : ৪৪)।

ইয়াযীদ রাকাশী রহ. বাড়িতে চিৎকার করে ঘুরে বেড়াতেন। এক পর্যায়ে বেহুঁশ হয়ে যেতেন। কথা বলার সময় গণ্ডদেশ ও দাড়ি বেয়ে চোখের পানি পড়তো। চোখের জলে নয়ন ভাসতো। বলতেন, ভাইয়েরা! কান্নার দিন আসার আগেই কান্নাকাটি কর। বিলাপের আগেই বিলাপ করে নাও। তওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই তওবা করে নাও। হে যুবসমাজ ও প্রৌঢ় ভাইয়েরা! নিজেদের জন্য বিলাপ কর। এ কথা বলে কাঁদতেন আর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতেন। হুঁশ ফিরে এলে আবার কাঁদতেন আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেন। অচেতন অবস্থায় বাড়িতে তুলে আনা হতো।

জনৈক ব্যক্তি বলল, আপনি এতো কাঁদেন। কেঁদে কেঁদে আপনার বিরক্তি আসে না? তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন, দুগ্ধশিশুর কি দুধ খেয়ে অরুচি ধরে? আল্লাহ’র কসম, আমার মনে চায় সারা জীবন চোখের পানি শেষ করে রক্ত ঝরাই। রক্ত শেষ করে পুঁজ ও পিত্ত পানি ঝরাই। কারণ আমরা তো জানি যে, জাহান্নামে জাহান্নামীরা চোখের পানি শেষ করে রক্ত ঝরাতে থাকবে।

প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, মৃত্যুর পরওয়ানা নিয়ে মালাকুল মওত যখন হাজির তখন তিনি কাঁদলেন। কেউ জিজ্ঞেস করলো, কাঁদেন কেন? বললেন, কসম, আমি তো ছুটে যাওয়া রাতের নামায এবং দিনের রোযাগুলোর জন্যই কাঁদছি। একথা বলে বিলাপ করতে লাগলেন। নিজেকে লক্ষ্য করে বললেন, হে ইয়াযীদ কে তোমার জন্য নামায পড়বে? কে তোমার জন্য সিয়াম সাধনা করবে? দুনিয়া থেকে তোমার চলে যাওয়ার পর কে তোমার জন্য আমাল দ্বারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করবে? অতীত গুনাহের জন্য কে তোমার জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে তওবা করবে? কী করুণা লাগে তার জন্য!! কবর যার থাকার ঘর! আল্লাহ তাআলার সামনে যাকে দাঁড়াতে হবে! জাহান্নাম যার আগামী দিনের ঘাঁটি! কী তুমি তোমার জন্য আগে পাঠিয়েছে? পাথেয় সংগ্রহ করেছো সামান্য কিছু দুনিয়ায় থাকতে? যেখানে তুমি পরাস্ত হয়ে পড়ে থাকবে তার জন্য কী তোমার প্রস্তুতি? তুমি তোমার প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর জন্য কী তৈরী করেছো?

হিজরী ১১০ থেকে ১২০ সালের মাঝে যেসব মনীষী দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন তাঁদের মধ্যে ইয়াযীদ রাকাশী রহ.ও রয়েছেন, একথা ইমাম বুখারী রহ. উল্লেখ করেছেন।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it