ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ২৪১ হিজরী : ৮৫৫ খৃস্টাব্দ)

ফেতনার অনলে দগ্ধ হয়ে যিনি সোনায় পরিণত হয়েছিলেন। ধৈর্য আর ঈমানের শক্তি দিয়ে যিনি বিপদ কাবু করেছিলেন। মায়ের উদরে যিনি ইমাম। কেমন যেন জন্মগতভাবেই তিনি শাস্ত্রবিশেষজ্ঞ ছিলেন। বিপদের সময় সিংহপুরুষ। সময়ের সেরা নরশার্দূল। দুনিয়ার ইমাম। অর্থকড়ির প্রতি নির্লিপ্ত। মানুষের পকেটের প্রতি যিনি লালায়িত নন। তিনি আবূ আব্দুল্লাহ্ আহমাদ ইবনে হাম্বল আশ্শাইবানী। মারওয়া বংশোদ্ভুত।
অনাথ অবস্থায় লালিত-পালিত হন। ইলমের প্রতি একাগ্রচিত্ত হয়ে বেড়ে ওঠেন। প্রত্যেক আলেমের বক্ষস্থ ইলম আহরণে দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এক পর্যায়ে সাহাবা কেরাম এবং তাবেঈদের মাযহাব সম্পর্কে তিনিই সবচেয়ে বড় আলেমে পরিণত হন। শৈশবকাল থেকে ইলমের প্রতি আসক্ত ছিলেন। সৎপরায়ণ ও নেককার লোকদের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে তিনিই হয়ে ওঠেন তাদের প্রধান ব্যক্তি।
বাদশাহ মামূনুর রশীদ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ.কে ‘কুরআন মাখলুক’ কুরআন সৃষ্ট আখ্যায়িত করতে আহ্বান করেন। এ নিয়ে বাহাছ করার আগেই বাদশাহ মারা যান। তারপর সিংহাসনে আরোহী হন বাদশাহ মু’তাসিম বিল্লাহ। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. কুরআন আল্লাহ তাআলা সৃষ্ট হওয়ার ব্যাপারে মত ব্যক্ত না করায় তিনি তাঁকে আটাশ মাস জেলে বন্দী করে রাখেন। পরবর্তীতে বাদশাহ মুতাওয়াক্কেল ক্ষমতায় এসে ইমাম আহমাদ রহ. খুব সম্মান-সমীহ করেন।
ইমাম নাসায়ী রহ. বলেন, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এর মাঝে হাদীস, ফিকহ এবং তাকওয়া-তাহারাতের মতো ভালো ভালো গুণের সমাহার ঘটেছিল। আব্দুর রাজ্জাক রহ. বলেন, ইমাম আহমাদের চেয়ে বড় কোন ফকীহ ও মুত্তাকী আমি দেখিনি। কেউ কেউ বলেছে, ইমাম আহমাদ রহ. না থাকলে তাকওয়াই মারা যাবে।
খরচ ও দানে সমুদ্রের ন্যায় ছিলেন। দারিদ্র্যের কষাঘাত কিংবা অভাবের অপচ্ছায়া কোনটাই তাকে ফেরাতে পারেনি। একদিন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এর সাথে হারূন মুস্তামলীর দেখা। তিনি বললেন, আমাদের কিছু নেই। তখন তাকে ইমাম আহমাদ রহ. পাঁচ দিরহাম দিলেন। বললেন, এগুলো ছাড়া আমার কাছে অন্য কোন কিছু নেই।
আবূ সাঈদ ইবনে আবূ হানীফা হযরত আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ.কে বললেন, আমি আপনার বাবার কাছে আসলে তিনি আমাকে দিন দিরহাম বা তারচেয়ে বেশি দিতো। পাশে বসিয়ে গল্প করতো। কখনও অন্য কিছুও দিতো। তিনি বলতেন, তোমাকে আমার অর্ধেক সর্বস্ব দিয়ে দিলাম। একদিন তার কাছে গল্প করতে আসলাম। পরে তিনি বের হলেন। তার চাদরের নিচে চারটি রুটি। বললেন, আমার যাবতীয় সম্পত্তির এগুলো অর্ধেক। আমি বললাম, অন্যদের দেওয়া চার হাজার থেকে এগুলো আমার নিকট অতি উত্তম।
তিনি তাকওয়ার নিদর্শন ছিলেন। খায়েশ ও সম্মোহন কোন কিছুই তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ইমাম আহমাদ রহ. এক ছেলেকে এক দিরহাম দিয়ে বললেন, এই দিরহাম দিয়ে মাখন কিনে আসো। ছেলেটি শালগমের পাতা মুড়িয়ে মাখন নিয়ে হাজির। তিনি দেখে বললেন, এই পাতা কোত্থেকে? ছেলেটি বলল, সবজিবিক্রেতা থেকে। ইমাম আহমাদ রহ. বললেন, অনুমতি নিয়েছো? সে বলল, না। তিনি বললেন, পাতাটি সবজি দোকানীকে ফেরৎ দাও।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. একটি পানপাত্র এক ব্যবসায়ীর নিকট বন্ধক রাখলেন। বন্ধক ছাড়িয়ে পানপাত্র নিতে আসলে ব্যবসায়ী সেটি বের করে দেয়। কিন্তু সেই পানপাত্রটি তার কি না এ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিল। তাই তিনি সেটা রেখে চলে গেলেন। ব্যবসায়ীকে বললেন, তুমি এটা ব্যবহার করতে পারো।
যুহদ ও দুনিয়াত্যাগের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তিনি লোকদের বিত্তবৈভব আর পদমর্যাদার দিকে তাকাতেন না। এই তো বিখ্যাত মুহাদ্দিস শাইখ আব্দুর রাজ্জাক বসে আছেন নিজের বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। কথার মাঝে আলোচনা করলেন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এর। ভাবাবেগে কাঁদলেন। গ-দেশে চোখের পানি ঝরছে। বলছেন, জানতে পারলাম, আহমাদ ইবনে হাম্বলের অর্থকড়ি নেই। দশ দীনার নিয়ে তাকে দিলাম। আহমাদ রহ. ঈষৎ হাসি দিয়ে বললেন, আবূ বকর! মানুষ থেকে কিছু নিলে তোমার থেকেও নিতাম। কিন্তু আমি তো লোকজন থেকে কোন কিছুই গ্রহণ করি না। একথা বলে তিনি আমার থেকে প্রস্তাবিত দশ দীনার গ্রহণ করলেন না।
তিনি যখন নামায পড়তেন সিজদা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে কপাল রেখে দোআ করতেন, হে আল্লাহ! যেভাবে আমার মুখম-লকে তুমি ছাড়া অন্য কিছুর জন্য সিজদা না করিয়ে হেফাজত করেছো তেমনিভাবে তুমি ভিন্ন অন্য কারো কাছে হাত পাতা থেকে তা হেফাজত ও মুক্ত রাখো। তিনি বলতেন, গুনাহের যদি দুর্গন্ধ থাকতো তোমাদের কেউ আমার কাছে বসতে না।
তাঁর আহার ছিল কয়েক লুকমা। বেঁচেবর্তে থাকার জন্য ছিল সেসব খাদ্যের গ্রাস। মাঝে মাঝে আহার্য না পেলে তখন খুশিতে অনুরণিত হতেন। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. পুত্র পিতার খাদ্যের বর্ণনা দিচ্ছেন। বাবাবে দেখিছি রুটির টুকরা নিচ্ছেন। ধূলো মুছে পাত্রে রাখছেন। পানি ঢেলে লবণ দিয়ে খেয়ে নিচ্ছেন। কখনও তাকে আনার, নাশপাতি বা অন্য কোন ফলফলাদি কিনতে দেখিনি। তবে কখনও কখনও খরবুজা কিনে রুটি দিয়ে খেতেন। মাঝে মাঝে তিন দিন ধরে কোন কিছুই খেতেন না। চতুর্থ দিনে সামান্য ছাতু পানি মিশিয়ে খেতে নিতেন। আবার সেটাও কখনও পুরোটা খেতেন না। তিনি বলতেন, আমার কাছে কিছুই না থাকলে আমি খুব আনন্দিত হই।
যখন তাকে জেলে পুরা হয়েছিল তখন তিনি খাবার কম খেতেন। খাওয়ার সময় তিনি শঙ্কিত থাকতেন না জানি দুনিয়া দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে!!
তিনি বলতেন, গতরাত অনেক ভেবেছি। মনে হল দুটি পরীক্ষার সম্মুখীন। দ্বীনের ব্যাপারে একটি পরীক্ষা যা উতরে এলাম। আর এটি দুনিয়ার পরীক্ষা। তিনি খাবার বেছে খেতেন। যার কারণে দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন। এমনও হতো ভিজা ন্যকড়া চেহারা মুছতে নিয়েও মুছতেন না। কেউ কেউ প্রস্তাব করলো, খরবুজা খেয়ে শক্তি সঞ্চার করলে তো নামায পড়তে বেশ সুবিধা হতো! তিনি বললেন, খরবুজা প্রশান্ত মানুষের খাবার। যারা আখেরাতের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত তারাই কেবল এই খাবার খেতে পারে।
ইবাদত বন্দেগীর মূর্তপ্রতীক ছিলেন। প্রত্যহ দিবারাত্রিতে তিনশত রাকাত নামায পড়তেন। জেলখানার বন্দজীবনে তিনি চাবুকের আঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়েন তখন তিনি দেড়শ রাকাত নামায পড়তেন। তখন তার বয়স আশি ছুঁইছুঁই করছিল।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. বেশি বেশি রোযা রাখতেন। সোমবার, বৃহস্পৃতিবার ও আইয়্যামেবেজের রোযা ছাড়তেন না। (আইয়্যামেবেজ : চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ)। সমর অভিযান শেষ করে আসার পর আমৃত্যু রোযা রেখেছিলেন। আবূ আইয়্যূব সিখতিয়ানী রহ. বলেন, আহমাদ ইবনে হাম্বলের মজলিসগুলো আখেরাতের মজলিস ছিল। সেসব আসরে দুনিয়ার কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো না। তাকে কখনও দুনিয়ার কোন কিছু নিয়ে আলোচনা করতে দেখিনি।
রাজা-বাদশাহদের দরবারে যাওয়া ঘৃণ্য বিষয় ছিল। তাদের হাদিয়া-উপঢৌকন তিনি প্রত্যাখ্যান করতেন। বাদশাহ মু’তাসিম বিল্লাহ্ পুলিশপ্রধান বলেন, যারা রাজদরবারে আসতো না এবং যারা বাদশাহদের সাথে সংশ্রব রাখতো না তাদের মধ্যে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের মতো দৃঢ়চেতা তখনকার দিনে আর কাউকে দেখিনি। তার দৃষ্টিতে আমরা (রাজ দরবারের লোকেরা) মাছির মতো ছিলাম।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. ইলমের চর্চার উদ্দেশ্যে ইসহাক ইবনে রাহওয়াইকে পত্র লিখতেন। ইসহাক ইবনে রাহওয়াইয়ের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তাদের মাঝে চিঠি-পত্রের আদান-প্রদান হতো। একবার ইসহাক রহ. এই মর্মে চিঠি লিখলেন, আমীর আব্দুল্লাহ্ ইবনে তাহির আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তার কাছে গেলাম। তখন আমার হাতে আপনার চিঠি ছিল। তিনি বললেন, আপনার হাতে কী? আমি বললাম, আহমাদ ইবনে হাম্বলের চিঠি। তিনি চিঠিটি নিয়ে পড়লেন। বললেন, আমি তাঁকে মহাব্বত করি। শাইখ হামযা বুশানজীকেও পছন্দ করি। কারণ এ দু’জন প্রশাসনিক কোন কাজে হস্তক্ষেপ করেন না।
এ কথা শোনে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. ইসহাক ইবনে রাহওয়াই’র নিকট পত্র লিখা বন্ধ করে দিলেন। ইতোমধ্যে আমীর আব্দুল্লাহ্ ইবনে তাহিরের দারোয়ান (দূত) এসে হাজির। বলল, বাদশাহ আপনাকে সালাম পাঠিয়েছে। তিনি আপনাকে দেখতে আগ্রহী!!!
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. বললেন, আমার অপছন্দের কাজগুলোর মধ্যে এটি একটি। (রাজদরবারে হাজিরি)। আর আমীরুল মুমিনীন আমার অপছন্দের কাজ করতে মার্জনা করবেন।
হযরত আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. মৃত্যুর কথা আলোচনা করলে অশ্রুবিধৌত নয়নে আক্রান্ত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়তেন। তিনি বলতেন, খোদাভীতি আমাকে পানাহার করতে দেয় না। মৃত্যুর কথা স্মরণ হলে দুনিয়ার সবকিছু সহজ হয়ে যায়। মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়ে গোঙাতে থাকেন। বলা হল, হযতর তাউস রহ. তো রোগশয্যায় পড়ে গোঙানো অপছন্দ করতেন। (আপনি কেন এমন করে কাঁদেন?) এরপর থেকে আমৃত্যু তিনি আর কখনও এমন করে কাঁদেননি।
লোকজন হযরত আহমাদ ইবনে হাম্বলের অসুস্থতা কথা শোনতে পায়। তারা দলে দলে আসতে থাকে। মানুষ এসে হযরত আহমাদ রহ.কে সালাম দিচ্ছে আর তিনি হাতের ইশারায় উত্তর দিচ্ছেন। জুমার দিন লোকজন অলিগলিতে জড়ো হয়ে পড়ে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ইমাম আহমাদ রহ. এই দুনিয়ার জগত ছেড়ে পরকালে পাড়ি জমান। এটা হিজরী ২৪১ সালের ঘটনা। লোকজনের মাঝে কান্নার রোল পড়ে যায়। চারদিকের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কেমন যেন গোটা দুনিয়াটা কেঁপে ওঠে। আট লক্ষ পুরুষ এবং ষাট হাজার নারী তাঁর জানাযায় শরীক হয়েছিল। হযরত ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এর মৃত্যুসংবাদ যখন ইয়াহ্ইয়া নিশাপুরী রহ. জানতে পারেন তখন তিনি বলেছিলেন, হযরত আহমাদ ইবনে হাম্বলের বিরহে বাগদাদের প্রতিটি ঘরের লোকদের বাড়িতে বসে কাঁদা উচিত।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it