ইব্রাহীম আত্তাইমী رحمة الله عليه (মৃ. ৯২ হিজরী : ৭১০ খৃস্টাব্দ)
শরীর নিয়ে পৃথিবীবাসী আর আমল নিয়ে যিনি আকাশবাসী। যাঁকে নিয়ে ফেরেশতাগণ জান্নাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ সংস্রবমুক্ত। আখেরাত-বাগে যাঁর হৃদয় লেগে আছে। যাঁর সেজদার গুঞ্জনে পাখিকুল আশীর্বাদ ছড়ায়। আনুগত্যের দু’হাত যাঁকে দুনিয়া থেকে দূরে রাখতে বাধ্য করে। তিনি ইব্রাহীম ইবনে ইয়াযীদ ইবনে শরীক আত্তাইমী রহ.। নেক ও মার্জিত ব্যক্তি। খোদাভীরু ও অতি বিনয়ী। ইসলামী আইনজ্ঞ ও ফকীহ। অনুকরণীয় ওয়ায়েজ। বুযূর্গ ও মুত্তাকী। ইবাদতগুজার। অনুপম আদর্শ ব্যক্তি। প্রয়োজন ও সুনির্দিষ্ট নিয়ত ছাড়া কখনও কথা বলেন না।
নামায পড়ার সময় যখন সেজদা করতেন পক্ষীকুল গাছের ডাল মনে করে তাঁর বুকে এসে বসতো। আউয়্যাম ইবনে হাওশাব রহ. বলেন, ইব্রাহীম তাইমী অপেক্ষা কোন ভালো মানুষ দেখিনি। নামাযে এবং অন্য সময়েও কখনও মাথা ওঠাতে দেখিনি। জাগতিক কোন কাজে লিপ্ত হতেও দেখিনি।
একদিন তিনি লোকদের কাছে আসলেন। তাদেরকে তিনি জাগতিক বিষয়ে উপদেশ দিতে লাগলেন। তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মাঝে সময়ের ব্যবধান আর কতটুকুই হয়েছে? এই তো সেদিন তাঁরা দুনিয়া ছেড়ে পরকাল জগতে চলে গেলেন। অথচ তাঁদের পদতলে দুনিয়া ঘুরঘুর করার পরও তাঁরা দুনিয়া প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু দুনিয়া তোমাদের উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছে আর তোমরা দুনিয়ার পেছনে ছুটে চলেছো।
এই লোকটির এতো যুহদ ও তাকওয়া সত্ত্বেও আমল ছিল কম। তিনি বলতেন, আমলের সাথে কথা মেলালে নিজেকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করতে হয়। কথা ও কাজে মিল পাই না। একদিন নির্জন অবস্থায় এবং জনমানবহীন নিভৃত হালতে ইব্রাহীম তাইমী চিন্তাজগতে নিমগ্ন হয়ে পড়লেন। তাঁর কাছে মনে হল, তিনি জান্নাতে বসে জান্নাতী ফলমূল খাচ্ছেন। জান্নাতের নহর-নালা থেকে পানীয় গ্রহণ করছেন। জান্নাতী রমণী নিয়ে মজে আছেন। আবার পরক্ষণে মনে হল, জাহান্নামে আছেন তিনি। জাক্কূম গাছ তার আহার্য। পুঁজ ও গলিত পানি তার পানীয়। জাহান্নামের বিভিন্ন বেড়ি ও নিগড়ে সে নিগড়িত। তিনি নিজেকে বললেন, হে মন! তুমি কোনটা গ্রহণ করবে? মনে সায় দিল, মনে চায় আবার দুনিয়ায় গিয়ে নেক আমল করি এবং জান্নাতের অনন্ত অসীম নেয়ামতরাজি উপভোগ করি। তিনি বললেন, হে মন, তুমি এই আশায় থেকে আমল করতে থাকো।
যুহদ, দুনিয়া এড়িয়ে চলা এবং সাদামাঠা পানাহার গ্রহণ বিষয়ে তিনি নিজের বর্ণনা দিচ্ছেন, ত্রিশ দিন কোন কিছু খাইনি এবং পান করিনি। পরিবারের লোকজন আমাকে একটি আনার দানা খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমার পেট তা গ্রহণ করেনি। জনৈক ব্যক্তি হযরত আ’মাশকে বললো, আপনার বিশ্বাস হয়? সে বলল, ইব্রাহীম তাইমী যদি বলেন, তিনি এখন আকাশ থেকে নেমে এসেছেন তাহলেও আমি বিশ্বাস করবো।
ইব্রাহীম তাইমী রহ. লোকদেরকে সতর্ক করতেন। তিনি তাদেরকে কম খেতে উৎসাহিত করতেন। বলতেন, মানুষ আনন্দ করে যত পানাহার করে আখেরাতে তার সে পরিমাণ হ্রাস পায়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইব্রাহীম আন্নাখয়ীকে খোঁজে ডেকে পাঠালেন। বার্তাবাহক ভুলে ইব্রাহীম তাইমীর নিকট এসে বলল, আমি ইব্রাহীমকে চাই। ইব্রাহীম তাইমী বললেন, আমি ইব্রাহীম। তিনি গ্রেফতার হলেন। অথচ তিনি জানেন যে, কাঙ্ক্ষীত লোকটি ইব্রাহীম নাখয়ী, ইব্রাহীম তাইমী নয়। তাঁকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিকট আনা হলে জেলে পুরা হল। জেলখানায় সূর্যের আলো থেকে বাঁচার জন্য কোন ব্যবস্থা ছিল না। আবার শীতের উপায়-উপকরণও ছিল না। শিকলে বন্দী তিনি। এতে ইব্রাহীম তাইমী বিগড়ে গেলেন। বন্দীদশায় ইব্রাহীম তাইমী মা আসেন। কথা বলার আগে চেহারা দেখে চিনতে পারেননি। এভাবে তিনি আমৃত্যু বন্দীদশায় ছিলেন। একদিন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ স্বপ্নে দেখেন, একজন লোক বলছে, এই রাতে এই শহরে জান্নাতী একলোক মারা গেছেন। সকাল বেলায় হাজ্জাজ বললেন, ওয়াসিত শহরে এই রাতে কি কেউ মারা গেছে? লোকজন বলল, হাঁ। এই জেলখানায় ইব্রাহীম তাইমী মারা গেছেন। হাজ্জাজ বললেন, এটা এলোমেলো দুঃস্বপ্ন। তারপর তাঁকে সমাহিত করা হয়। হিজরী ৯২ সালের ঘটনা।