আহনাফ ইবনে কাইস رحمة الله عليه (মৃ. ৭২ হিজরী : ৬৯১ খৃস্টাব্দ)
মর্যাদা ছেড়ে পালিয়েছেন যিনি। মর্যাদা ও গৌরব যাঁর পেছনে দৌড়াতো। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী হওয়ার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হলেও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যর্থ হননি। তিনি চটে গেলে তাঁর সাথে লক্ষ (ভক্তবৃন্দ) লোক বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতো। গর্ভকালীন সময়ে নেতৃত্বে আসার মতো যোগ্যতা যাঁর ছিল। অসাধারণ আরব ব্যক্তিদের তিনি একজন। প্রজ্ঞা ও যুহ্দের ময়দানে অন্যতম অশ্বারোহী। তিনি আলআহ্নাফ ইবনে কাইস ইবনে মুয়াবিয়া ইবনে হুসাইন আলমুররী আসসা’দী আত্তামীমী। আবূ বাহর। পায়ের নলায় সামান্য বক্রতা থাকার কারণে আলআহনাফ নামে সুবিদিত ছিলেন। চেহারায় তেমন সৌন্দর্য ছিল না। বামন প্রকৃতির হয়েও তিনি ছিলেন চৌকস আরবদের একজন। অসাধারণ মুসলিম প-িতদের একজন।
তিনি তামীম গোত্রের প্রধান ব্যক্তি। গাঁয়ের মাথা। বাগ্মী ও বীরপুরুষ। সহনশীলতায় কিংবদন্তী এবং তুলনীয় ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোআ করেছিলেন। কৃতজ্ঞতায় সিজদা করেছিলেন। বলেছেন, কেয়ামত দিবসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দোআর চেয়ে আমার অন্য কোন আমলের ব্যাপারে আমি আশাবাদী নই।
বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। এতিম অবস্থায় বেড়ে ওঠেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনকাল পেয়েছিলেন। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর দেখা হয়নি। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর শাসনামলে মদীনায় প্রতিনিধি দল নিয়ে এসেছিলেন। হযরত উমর রা. তাঁকে থাকার জন্য বললে তিনি এক বছর মদীনা শরীফে অবস্থান করেছিলেন। পরবর্তীতে অনুমতি প্রদান করলে তিনি বসরায় ফিরে যান। হযরত উমর রা. আবূ মূসা আলআশআ’রী রা. পত্র লিখে জানিয়েছেন যে, আহনাফকে কাছে রাখুন, তাঁর সাথে পরামর্শ করুন এবং তাঁর কথা আমলে নিন।
খুরাসান অঞ্চলে বিভিন্ন সমর অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। জামাল যুদ্ধের সত্য-মিথ্যার ঘেরাটোপে নিজেকে জড়াননি। পরবর্তীতে সিফফিন যুদ্ধে হযরত আলী রা. এর বাহিনীর সাথে শরিক হয়েছিলেন। নিজেই নিজের হিসাব-নিকাশ নিতেন। বলতেন, আমি নিজেকে কুরআনের নিকট পেশ করেছি। আমি নিজেকে এই আয়াতের সাথে বেশি মিল দেখতে পাচ্ছি।
আয়াতটি এই :
وَآخَرُونَاعْتَرَفُوابِذُنُوبِهِمْخَلَطُواعَمَلًاصَالِحًاوَآخَرَسَيِّئًاعَسَىاللَّهُأَنْيَتُوبَعَلَيْهِمْإِنَّاللَّهَغَفُورٌرَحِيمٌ ()‘এবং অপর কতক লোক নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছে, তারা এক সৎকর্মের সাথে অপর অসৎকর্ম মিশ্রিত করেছে। আল্লাহ হয়তো তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা তওবা, আয়াত : ১০২)
নিজের একান্তে ও নির্জনে আকুতি-মিনতি করে হাত তুলে বলতেন, হে আল্লাহ! তুমি যদি আমাকে শাস্তি দাও আমি তো সেটার যোগ্য। আর যদি আমাকে মাফ করে দাও সেটা তুমি করতে পারো। তুমি ক্ষমা করে দেয়ার যোগ্য। তিনি বলতেন, যে মূত্র-পথে দু’বার চলে বেড়ায় সে আবার কিভাবে বড়াই করে? বিস্ময় লাগে যোনিপথে গমনাগমন করে আবার গর্ব। আহনাফ নিজ গোত্রে শীর্ষ অবস্থায় পৌঁছেছিলেন। গোত্রের নেতা ছিলেন। নেতৃত্ব করেছিলেন মেধা, বুদ্ধি, সহনশীলতা ও যুহ্দ-তাকওয়ার বদৌলতে। তারা তাঁর সম্মানার্থে বলেছিল, আপনার জন্য একটা ‘সুরাদিক’ বা বেষ্টনি বানিয়ে দিবো? বিনয়ের সঙ্গে বললেন, সুরাদিকের কথা তো কুরআন জাহান্নামের ব্যাপারে বিবৃত করেছে। আল্লাহ’র দোহাই, তোমরা আমার জন্য কখনও সুরাদিক নির্মাণ কর না। (তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন এই আয়াতের দিকে (অনুবাদ) ‘আমি জালিমদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি আগুন। যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে।’ (সূরা কাহ্ফ, আয়াত : ২৯)
আমৃত্যু তাঁর ঘর ছিল বাঁশের একটি ঝুপড়ি। একদিন আলআহনাফ ইবনে কাইস সফর সেরে আসলেন। এসে দেখলেন, বাড়ির লোকজন তাঁর ঘরের ছাদটি রঙিন করে দিয়েছে। দেখে তিনি বললেন, আমাকে মাফ করেন। পরিবর্তন না করলে আমি তাতে প্রবেশ করতে পারবো না। একবার তিনি জিজ্ঞাসিত হলেন, কীভাবে আপনি গোত্র-প্রধান হলেন? তিনি বললেন, লোকজন কোন পানীয় সম্পর্কে অভিযোগ তুললে আমি সেটা পান করি না। (সন্দেহের বিষয় আমি গ্রহণ করি না)।
অসুস্থ ব্যক্তির ন্যায় ছটফট করতেন। আল্লাহ’র আযাবের ডরে সন্তানহারা মায়ের মতো কাঁদতেন। আলআহনাফের আযাদকৃত গোলাম মনিবের একান্ত অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তিনি নির্জনে থাকলে কুরআন শরীফ আনাতেন। তাঁর অপর গোলাম বলে, আলআহনাফের রাতের অধিকাংশ নামায ছিল দোআ ও প্রার্থনা। যখনই কোন গুনাহ বা দোষের বিষয় উপলব্ধি করতে পারতেন তখনই তিনি চেরাগে হাত রেখে বলতেন, স্বাদ গ্রহণ কর! পরক্ষণে বলতেন, আহনাফ! কেন এমন করলে? সেদিন ঐ কাজ কেন করলে?
সিয়াম সাধনায় বেশি অনুরাগী ছিলেন। এমনটি বার্ধক্য সময়েও তিনি রোযা রাখতেন। কেউ বলল, আপনি তো বুড়ো। এই বয়সে রোযা রাখলে তো দুর্বল হয়ে পড়বেন। তিনি বললেন, আমি তো দীর্ঘ সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করছি।
সহনশীল ও সহিষ্ণু আরবদের একজন হলেন আহনাফ। অসাধারণ বিদ্বান ব্যক্তি। একদিন তিনি বসরা নগরীর কোল ঘেঁষে নির্জনে হেঁটে চলছেন। এক লোক তাঁকে গালি দিতে লাগল। দোষারোপ করতে আরম্ভ করে দিল। তিনি নীরব। রাস্তা দিয়ে হেঁটেই চলেছেন। যখন দু’জন মানুষের কাছে ঘনিয়ে এলো। আহনাফ লোকটির দিকে তাকিয়ে শান্তশিষ্ট হয়ে বললেন, ভাতিজা, তোমার যদি কোন কথা আরও বাকি থাকে এখন তা বলো। কারণ আমার গোত্রের লোকেরা যদি তোমার কথা শুনতে পায় তারা তোমাকে কষ্ট দিবে।
আলআহনাফ ইবনে কাইস একবার বাড়ির ছাদে উঠলেন। প্রতিবেশি লোকদের প্রতি নজর পড়তেই কাঁপা কণ্ঠে বললেন, অনেক অনেক খারাপ কাজ করেছি। প্রতিবেশির অনুমতি ছাড়াই তাদের দিকে নজর দিলাম। আর কখনও এভাবে বাড়ির ছাদে উঠবো না।
আহনাফ প্রবেশ করলেন হযরত মুয়াবিয়া রা. এর নিকট। আসরের লোকদের সাথে তিনি নীরবে বসে রইলেন। হযরত মুয়াবিয়া রা. বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনি কেন নীরব? কোন কথা বলছেন না কেন? আহনাফ নম্রভাষায় উত্তর দিলেন, মিথ্যা কথায় আল্লাহকে ডরাই। আর সত্য কথায় আপনাদেরকে ডরাই।
আল্লাহ’র কোন সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ’র কাছে নালিশ করেননি। তিনি বলতেন, আজ চল্লিশ বছর হল আমার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছি। কারো কাছে এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ করিনি। লোকজন তাঁর কাছে প্রশংসা করতে এসে বলল, হে বিদ্যাসাগর! আপনার মতো কোন সহনশীল মানুষ আমরা আর দেখিনি!! লজ্জায় তিনি আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। তারিফ করা অপছন্দনীয়। তিনি বললেন, তিনটি জিনিসের ব্যাপারে নিজেকে তাড়াতাড়ি করতে দেখেছি। তোমাদের দৃষ্টিতে আমি সহনশীল হলেও আমার দৃষ্টিতে আমি জলদিবাজ। তারা বলল, সেই তিনটি জিনিস কী? বললেন, নামাযের সময় হলে। আমি তা তৎক্ষণাৎ আদায় করে ফেলি। কোন অবিবাহিত নারীর যথাযথ পাত্র পাওয়া গেলে আমি তার বিয়ের ব্যবস্থা সাথে সাথে করি। কোন মানুষ মারা গেলে আমি তাকে কবরস্থ করতে দেরি করি না।
আহনাফের অনেক কারামাত রয়েছে। লোকাতীত ঘটনা তাঁর জীবনব্যাপী। একবার পিঁপড়া বেড়ে গেল। তাঁকে কষ্ট দিতে লাগল। তিনি একটা চেয়ার আনতে বললেন। চেয়ারটি তিনি পিঁপড়ার গর্তের মুখে রাখলেন। আল্লাহ তাআলার তারিফ করে বললেন, তোমরা আমাদেরকে কষ্ট দিয়েছো। আর কষ্ট দিয়ো না। কষ্ট দিলে আমরাও তোমাদেরকে কষ্ট দিবো। একথা শোনে পিঁপড়া চলে গেল। আর কষ্ট দিলো না।
আহনাফের সহনশীলতা প্রবাদতুল্য ছিল। একদিন তিনি বাড়ির উঠানে বসে আছেন। হঠাৎ অনেক লোক হাতে একটি নিহত বাচ্চাকে নিয়ে হাজির। বাচ্চাটি আহনাফের। এদিকে তাঁর ভাতিজা বেড়িতে নিগড়িত। লোকজন বলল, আপনার ভাতিজা আপনার ছেলেকে হত্যা করেছে। এ কথা শোনে আহনাফ সামান্য নড়লেন না। নিজের আসনের কোন পরিবর্তন হল না। এরপর ধীরস্থিরভাবে বললেন, ভাতিজা! তুমি তোমার পরওয়ারদেগারের নাফরমানি করলে। নিজের পায়ে কুড়াল মারলে। চাচাতো ভাইকে খুন করলে। এরপর নিজের আরেক ছেলেকে বললেন, বৎস! যাও তুমি তোমার চাচাতো ভাইয়ের শিকল খুলে দাও। তুমি তোমার ভাইয়ের মরদেহ কবরস্থ করে দাও। তার আম্মাকে ছেলের দিয়ত (রক্তমূল্য) হিসেবে একশত উটনী পৌঁছে দাও। কারণ তার আম্মা ভিনদেশী। হযরত আহনাফ হযরত মুসআব ইবনে যুবাইর রা. এর বন্ধু ছিলেন। কুফায় থাকতে তিনি তাঁর কাছে এসেছিলেন। হিজরী ৭২ সালে তিনি মারা যান।