আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাইরিয رحمة الله عليه (মৃ. ৯৯ হিজরী : ৭১৮ খৃস্টাব্দ)
যাঁর রাগে মহান আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হন। যে জাতির মাঝে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাইরিয এর মতো ব্যক্তি আছেন সে জাতি কখনও গোমরাহ হবে না। পথ হারাবে না মুসলিম উম্মাহ; কারণ তাঁদের মধ্যে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাইরিয রহ. এর ন্যায় মহামনীষী রয়েছেন। যিনি দ্বীনের বিনিময়ে একটি লুকমাও গ্রহণ করেননি। আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় স্থানে দান করে যিনি দানশীল। জগতের প্রিয় স্থানে কার্পণ্য করে যিনি কৃপণ! যাঁর দুনিয়া ভুলিয়ে দিতে পারেনি তাঁর আখেরাতকে। তিনি বিখ্যাত ইমাম ও আইনজ্ঞ, আদর্শ অনুকরণীয় বুযূর্গ আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাইরিয ইবনে জুনাদাহ ইবনে ওয়াহাব, আবূ মুহাইরিয আলকুরাইশী আলযুমাহী আলমক্কী রহ.।
বিখ্যাত আলেমে দ্বীন ও শীর্ষস্থানীয় তাবেঈ। নীরবতাপ্রবণ ব্যক্তি। বাড়ির কোণে নির্জন-নিভৃতে থাকতেন। নিজের গুণাবলী যিনি বেশি বেশি গোপন রাখতেন। আত্মভোলা নিভৃতচারণে লালায়িত এক মনীষী। সত্য প্রকাশে একনিষ্ঠ। যাঁর হৃদয়ে রয়েছে চাখা চাখা ইলম ও প্রজ্ঞা। হারাম শরীফ এলাকায় তিনি অসাধারণ এক পণ্ডিত। প্রতি সপ্তাহে একবার কুরআন শরীফ খতম করতেন। তাকওয়া ও পরহেযগারির ময়দানে নিজেকে আগলিয়ে রেখেছেন। নেক ও সৎ মানুষের কাতারে নিজেকে জড়িয়েছেন সযত্নে।
ইমাম আওযায়ী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি কোন মনীষীকে অনুসরণ করতে আগ্রহী সে যেন ইবনে মুহাইরিযের মতো কাউকে অনুসরণ করে। দয়াবান আল্লাহ তাআলা এমন জাতিকে ধ্বংস করবেন না যেখানে ইবনে মুহাইরিয রয়েছে। রাযা ইবনে হায়াত বলেন, ইবনে মুহাইরিযের বেঁচে থাকা মানুষের জন্য নিরাপত্তা। তিনি আরও বলেন, মদীনা মুসলমানগণ যদি তাঁদের আবেদ ইবনে উমর রা. নিয়ে গর্ব করে আমরা মক্কাবাসী তাঁদের মোকাবেলায় আমাদের আবেদ ইবনে মুহাইরিয নিয়ে গর্ববোধ করি।
ইবনে মুহাইরিয রহ. শিষ্টাচারস্বরূপ বলতেন, যে লোক নিজের বাবার সামনে দিয়ে আগে আগে হেঁটে যায় সে তার বাবার অবাধ্যতা করলো। এটাও এক ধরনের বেআদবি। তবে যে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক কোন কিছু সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাবার আগে হেঁটে যায় সেটা ভিন্ন কথা।
এই বুযূর্গ মানুষ সুনাম-শোহরত অপছন্দের ছিল। স্তাবক ও গুণগ্রাহী লোকদের আতঙ্কে থাকতেন। দুনিয়া দিগন্তে নিজের সুনামের নামটি পতপত করে উড়ে বেড়ানোকে ঘৃণা করতেন। একদিন তিনি গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। ভক্তবৃন্দের মাঝে ইলম ও প্রজ্ঞার আলো ছড়াবেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাদীস শরীফ শোনাবেন। তিনি ভীতবিহ্বল হয়ে বললেন, আমি তোমাদেরকে হাদীস শরীফ শোনাবো। তবে তোমরা ‘ইবনে মুহাইরিয হাদীস শুনিয়েছেন’ এভাবে বলো না। আমার আশঙ্কা হয়, এ কথা আমার জন্য দুর্ভোগের কারণ হয় কিনা!
একান্তে নিজেই নিজেকে ভর্ৎসনা করতেন। দু’হাত তুলে দোআ করতেন। হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে প্রার্থনা করি তুমি আমাকে অখ্যাত ও অজ্ঞাত করে রাখো। ক্বারী আব্দুল্লাহ্ ইবনে আওফ বর্ণনা দিচ্ছেন যে, আলেকজান্দ্রিয়া বিপরীত রোম নিয়ন্ত্রিত বিরোদিস উপদ্বীপে পরিচালিত সমর অভিযানে মুসলিম বাহিনীর সাথে তিনি ছিলেন। মুসলিম সৈন্যবাহিনীর সাথে ইবনে মুহাইরিয রহ.ও ছিলেন। গোটা মুসলিম সৈন্যবাহিনীর মাঝে ইবনে মুহাইরিযের চেয়ে অধিক নামায আদায়কারী দ্বিতীয় কেউ ছিল না। এ কথা যখন ছড়িয়ে পড়ে, তারিফের কথা মুখে মুখে রটে যায় তখন তিনি নামায কমিয়ে দেন।
তাঁর তাকওয়া ও পরহেযগারির কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। মর্যাদা ও গুণকীর্তন হৃদয়ে হৃদয়ে স্থান করে নেয়। একদিন তিনি কাপড় বিক্রেতার দোকানে কাপড় কিনতে প্রবেশ করলেন। দোকানি তাঁকে চিনে না। ইবনে মুহাইরিয রহ. বললেন, এক কাপড়ের দাম কত? বিক্রেতা একদাম বলল। এমন সময় দোকানে থাকা ইবনে মুহাইরিযকে চেনে এমন এক ব্যক্তি তারস্বরে বলে উঠলো, ইনি ইবনে মুহাইরিয! সুলভ মুল্যে (বা কম দামে) বিক্রি কর! ইবনে মুহাইরিয রহ. রেগে গেলেন। চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। বললেন, আমি তো টাকা দিয়ে কাপড় কিনতে এসেছি। দ্বীন দিয়ে দ্রব্য-সামগ্রী কিনতে আসিনি। একথা বলে কিছু না কিনে দোকান থেকে বের হয়ে গেলেন।
আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাইরিয রহ. রাজা-বাদশা এবং আমীর-উমারাদের হাদিয়া-উপঢৌকন গ্রহণ করতেন না। (তার প্রমাণ) একবার বাদশাহ আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান একটি কাজের বুয়া (বাঁদি) ইবনে মুহাইরিয রহ. এর নিকট পাঠালেন। বাড়িতে বাঁদি প্রবেশ করতেই তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। সেই বাড়িতে আর প্রবেশ করলেন না। কেউ বলল, আমীরুল মুমিনীন! আপনি তো ইবনে মুহাইরিযকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। তিনি বললেন, কীভাবে? তারা বলল, আপনার প্রেরিত বাঁদি বাড়িতে ঢুকতেই তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। এরপর আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান সেই বাঁদি নিয়ে গেলেন। আর এদিকে ইবনে মুহাইরিযও বাড়িতে প্রবেশ করলেন। আরেক দিনের ঘটনা। ইবনে মুহাইরিয সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিকের কাছে গেলেন। তিনি প্রশ্ন রাখলেন, ইবনে মুহাইরিয! জানতে পারলাম, আপনার ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন? তিনি বললেন, হাঁ। সুলাইমান বললেন, আমি তার মোহর আদায় করে দিবো। ইবনে মুহাইরিয বললেন, নগদ মোহর তো আদায় করা হয়েছে। বাকি মোহর এখনো রয়ে গেছে। তখন বেলাল ইবনে আবী বুরদা রহ. বললেন, ইবনে মুহাইরিয! আমীরুল মুমিনীনের হাদিয়া গ্রহণ করুন। (কিন্তু তা গ্রহণ করেননি)। ইবনে মুহাইরিয যখন আমীরুল মুমিনীনের দরবার থেকে বের হয়ে গেলেন পেছনে পেছনে ইবনু আবী বুরদাও বের হল। ইবনে মুহাইরিয রহ. বললেন, ইবনু আবী বুরদা কখন থেকে সুলাইমানের পুলিশ হল?
আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাইরিয রহ. আমীরুল মুমিনীন ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিক এর শাসনামলে পরলোকগমন করেন। হিজরী ৯৯ সালে তিনি দুনিয়া ছেড়ে পরওয়ারদেগারের নিকট চলে যান।