আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রাযিআল্লাহু আনহু (মৃ. ৩২ হিজরী : ৬৫৩ খৃস্টাব্দ)
যাঁর পদের নিম্নভাগ আমলনামার নিক্তিতে উহুদ পর্বতের চেয়ে অধিক ভারী ও ক্ষমতাসম্পন্ন। র্শিক ও পৌত্তলিকতার কর্ণকুহরে যিনি সর্বপ্রথম কুরআনের গগনবিদারী আওয়াজ তুলে ধ্বনিত করেছিলেন। যাঁর বিশ্বাস ও ঈমান ছিল সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সুদৃঢ় ও অবিচল। যাঁর ঈমানের কাছেও ঘেঁষতে পারেনি দুর্বলতাজনিত কোন দ্বিধা ও দোটানা। ক্ষীণ শরীর নিয়ে যিনি নিজেকে ফেলেছিলেন ধ্বংস ও নিধনের শ্বাদন্তে। জীবনবাজি রেখে যিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন সম্মুখপানে।
তিনি উম্মে আবদ তনয় আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ। যিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন ওহী ও আসমানী বার্তার অরুণোদয়। উঠতি বয়সে পেয়েছিলেন হেদায়েত ও হেরার আলোর উপজীব্য। প্রথম ও অগ্রবর্তীদের মধ্যে যিনি স্থান করেছিলেন। ছয়জনের তিনি একজন, যাঁরা নিজেদের হৃদয়কে ঈমানের পুষ্টি দিয়ে পুষ্ট করেছিলেন।
মহানবী ﷺ-এর দারে আরকামে প্রবেশ করার আগেই তিনি মুসলমান হয়েছিলেন। শিরক ও পৌত্তলিকতার কানে ধ্বনিত করেছিলেন কুরআনের সুমধুর আওয়াজ। ঈমানের সততায় পরাস্ত করেছিলেন কুরাইশ সম্প্রদায়ের গরিমা। চূর্ণবিচূর্ণ করেছিলেন কুফরের প্রতাপ। রাজ্যের নির্যাতন ও অত্যাচার তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। কুফরের বাহুবেষ্টিত হয়েছিলেন তিনি। আক্রান্ত এই সাহাবী মহানবী ﷺ-এর অনুমতিক্রমে চলে যান আবিসিনিয়ায়। পরবর্তীতে হিজরত করেন মদীনা শরীফে। বদরসহ ইসলামী সকল সমর অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি মহানবী ﷺ-এর একান্ত সঙ্গী ছিলেন। সম্মুখে ও একান্তে তিনি রাসূলের সাথে ছায়ার ন্যায় ছিলেন। অন্যদের জন্য যখন প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল তখনও তাঁর প্রবেশাধিকার ছিল। সবসময় প্রবেশাধিকার তাঁর জন্য অবারিত ছিল। অন্যরা অনুপস্থিত থাকলেও তিনি থাকতেন সদা উপস্থিত। চেহারা ও চালচলনে নবীজী ﷺ-এর সাথে যাঁর মিল ছিল। নবীজী ﷺ আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা.-কে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর-এর সাথে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, উম্মে আবদ পুত্র (আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ) যে বিষয়ে রাজি আমার উম্মতের জন্য আমিও সে বিষয়ে রাজি। (মুসতাদরাকে হাকেম ৩/ ৩১৭)
ইবনে মাসঊদ রা. ছিলেন যুহদ ও দুনিয়া বিমুখিতার সুরক্ষিত দুর্গ। ইলম ও জ্ঞানের বাতিঘর। দু’হাতে প্রতিবিধান করেছিলেন দুনিয়া ও জগত-সংসার। নিজেকে নিকষিত করেছিলেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। নিজেকে সাধনার দগ্ধতায় নিমগ্ন রেখে পরিশুদ্ধ করেছিলেন। হয়েছিলেন বিদগ্ধ ব্যক্তি।
তাঁর বাণীগুলো ছিল ইয়াকিন ও সুদৃঢ় ঈমান পরিপূর্ণ এবং আকল-বুদ্ধি সমৃদ্ধ। যেগুলোর স্থান ছিল হিকমত ও প্রজ্ঞার শীর্ষে। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা. বলেন, আদম সন্তানের দৃষ্টান্ত সেই বস্তুর ন্যায়, যা আল্লাহ এবং শয়তানের মাঝে নিক্ষিপ্ত। তা যদি আল্লাহ’র উদ্দেশ্যে হয় তিনি তা শয়তান থেকে সুরক্ষা করবেন। আর যদি আল্লাহ উদ্দেশ্যে না হয় তা শয়তানের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
তিনি তাঁর ছেলেকে উপদেশ ছলে বলেছিলেন, বৎস! তোমার বাড়ি তোমার জন্য যথেষ্ট হওয়া চাই। নিজের জবান ও ভাষার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখো এবং নিজের গুনাহ ও পাপের জন্য কান্নাকাটি করো। তিনি বলেছেন, দুনিয়ার সেরা অংশ তিরোহিত হয়েছে রয়ে গেছে তার ছোবা। এখন মৃত্যু প্রত্যেক মুসলিমের জান্নাত।
তিনি বলতেন, খোদাভীতির জন্য ইলম ও আসমানী জ্ঞানই যথেষ্ট। আর আত্মপ্রতারণার জন্য মূর্খতাই ঢের। দুনিয়া তার বাসস্থান যার (পরকালে) বাড়ি নেই। যার সম্পদ নেই তার সম্পদ দুনিয়া। আর এই দুনিয়ার জন্য কামাই-রোজগার করে যার কা-জ্ঞান নেই। ঐ সত্তার কসম, যিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। কোন মুসলিমের ইসলামে সকাল বা সন্ধ্যায় তেমন কোন ক্ষতি হয় না যে ক্ষতি করতে পারে জগত-সংসার। যদি জাহান্নামীদের প্রতিশ্রুতি দেয়া যে, একদিন তাদের শাস্তি লাঘব করা হবে তাহলে তারা খুশিতে মারাই যাবে। দুনিয়ার যে কোন ব্যক্তি সকালে সে মেহমান আর তার হস্তগত সম্পদ তার হাতে ধার করা। মেহমান তো কোন সময় প্রস্থান করবে আর ধার করা জিনিস তো ফেরত দেওয়া লাগবে।
যুহদ ও দ্বীন বিষয়ক তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণী
‘সর্বাধিক কথা হল কিতাবুল্লাহ্, আল্লাহ গ্রন্থ, আল-কুরআনুল কারীম। সুসংহত হাতল তাকওয়ার কথা। সকল ধর্ম ও দ্বীনের মাঝে শ্রেষ্ট ধর্ম হল ইবরাহীম আ. এর ধর্ম। সর্বাধিক সুন্দর আদর্শ মহানবী ﷺ-এর সুন্নত ও আদর্শ। অতি শ্রেষ্ট কথা আল্লাহ যিকির। সবচেয়ে সুন্দর গল্প আল-কুরআন। সবভালো যার শেষ ভালো। নতুন কোন কিছু সৃষ্টি (করা তথা বেদআত প্রবর্তন করা) সর্বাধিক মন্দ কাজ। অপ্রতুলে যথেষ্ট প্রাচুর্যের মোহাচ্ছন্ন অপেক্ষা অনেক ভালো। নিরাপদ সামান্য সময় অনিরাপদ অনেক সময় থেকে উত্তম। নিকৃষ্ট ভর্ৎসনা মৃত্যুমুখের ভর্ৎসনা। কেয়ামত দিবসের লজ্জা নেহাত খারাপ। হেদায়েত পরবর্তী গোমরাহী অতিশয় মন্দ। মনের প্রাচুর্যই আসল ধনাঢ্যতা। তাকওয়া হল সর্বশ্রেষ্ঠ পাথেয়। হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ শিকড়িত বস্তু হল ইয়াকীন ও সুদৃঢ় ঈমান। সংশয়-সন্দেহ কুফরির (ছিদ্রপথ)। মনের অন্ধত্ব প্রকৃত অন্ধতা। শরাব-মদ্য সকল গুণাহ ও পাপরাশির সূতিকাগার। নারী শয়তানের ফাঁদ। তারুণ্য একধরনের বাতুলতা। শোক-বিলাপ ও মর্সিয়া জাহিলী প্রথা। কতক মানুষ জুমার নামাযান্তে অংশগ্রহণ করে এবং উদাসীনভাবে আল্লাহকে স্মরণ করে। মিথ্যা সকল গুণাহের সেরা গুনাহ। মুমিনের সাথে খিস্তিখেউর করা পাপ আচরণ আর তাঁকে খুন করা কুফরি কাজ। সম্পদের মর্যাদা জানের মর্যাদার ন্যায়। যে (অন্যকে) ক্ষমা করে তাকে আল্লাহ মাফ করেন। যে রাগ সংযত করে আল্লাহ তাকে প্রতিদান ও সওয়াব দান করেন। যে মার্জনা করে আল্লাহও তাকে মার্জনা করেন। বিপদে যে সবর করে পরিণামে আল্লাহ তাকে খুশি করেন। সুদের রোজগার সর্বাধিক নিকৃষ্ট কামাই। অনাথের সম্পদ গ্রাস করা নিকৃষ্ট গলাধঃকরণ। এতিমের মাল অতি নিকৃষ্ট আহার্য। যে অন্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সে সৌভাগ্যবান। যে মাতৃগর্ভে হতভাগা সেই আসল কপালপোড়া। প্রত্যেকের জন্য বেঁচেবর্তের উপকরণ যথেষ্ট। সবাই চার হাত (কবরের) দিকে ধাবমান। পরিণতিতে সবার গন্তব্য কবর। পরকালই পরিণাম। কাজের মূল্যায়ন তার পরিণতি। মিথ্যা ও অসত্যের বিবরণ অতি নিকৃষ্ট। শাহাদাতের মৃত্যু সেরা মৃত্যু। পোড়া-খাওয়া মানুষ বিপদে ধৈর্যধারণ করে। অন্যরা হাহুতোশ করে। অহঙ্কারের পতন হয়। দুনিয়া লাভের সাধ্যাতীত চেষ্টায় পরিণামে অক্ষমতা। লোকাতীত জাগতিক প্রাচুর্য পরিণামে ভোগায়। শয়তানের আনুগত্যে আল্লাহ নাফরমানি। যে নাফরমানি করবে আল্লাহ তাআলা তাকে শাস্তি দিবেন।’
তাঁর বুকে ছিল পূত-পবিত্র প্রকৃতি। স্বচ্ছ নদীতে সন্তরণশীল পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত মন। এই তো সত্যের আলো তিনিই প্রথম গ্রহণ করছেন। দু’চোখে দেখছেন সেই জ্যোতি। তিনি বলেন, আমি ছিলাম তারুণ্যে উদ্দীপ্ত এক যুবক হয়তো কিশোর। ইবনে আবী মুআ’ইত গিরিপথে মেষছাগলের পাল চরাচ্ছি। ইতোমধ্যে উপস্থিত মহানবী ﷺ-এর সাথে আবূ বকর রা.। উভয়ে বললেন, হে ছেলে, তোমার কাছে দুধ আছে? থাকলে আমাদেরকে একটু পান করাও। আমি বললাম, আমি কীভাবে পান করাবো। এগুলো চরানো আমার দায়িত্ব। আমি তো এগুলোর মালিক নই। আমি আপনাদেরকে পান করাতো পারবো না। বললেন, তোমার কাছে এমন কোন ছাগল আছে যা এখনো দুধ দেওয়ার সময় হয়নি? বললাম, হাঁ। তাঁদের কাছে কম বয়সের একটা ছাগলের বাচ্চা নিয়ে আসলাম। নবীজী ﷺ ছাগলের ওলানে ধরে পরওয়ারদেগারের নিকট দোআ করলেন। দুধে ওলান ভরে গেল। তিনি তা দোহন করলেন। তিনি ও আবূ বকর সেই দুধ পান করলেন। আমিও পান করলেন।
এরপর নবীজী ﷺ ওলানের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, চুপসে যাও। তার দুধ চুপসে গেল। আমি তাঁকে বললাম, যে মন্ত্রটি দিয়ে ওলানে দুধ আনলেন সেটি আমাকে শিখান। তিনি বললেন, তুমি শিখতে পারবে।
মহানবী ﷺ-এর ভালোবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আদব তাঁর হৃদয়জুড়ে ছিল। (তাঁর শিষ্য) হযরত আলকামাহ রহ. বলেন, আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা. প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হাদীস শরীফ বর্ণনা করতেন। সান্ধ্যকালীন সেই জলসাগুলোর এক জলসায় তাঁকে এ কথা বলতে শুনিনি যে, তিনি বলছেন, ‘রাসূলুল্লাহ্ ﷺ’ বলেছেন। শুধু একবার তাঁকে এমনভাবে বলতে শুনেছি। দেখতে পেলাম, অনিচ্ছাকৃত সেই ভুলের কারণে তাঁর ভর দেওয়া লাঠিটা কাঁপছে। (অতি সতর্কতামূলক অনেক সাহাবী বর্ণিত হাদীসটি নিজেদের পক্ষ থেকে ভুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সরাসরি বলতেন না যে, নবীজী ﷺ বলেছেন। বরং তাঁরা শুধু হাদীসটি বলে যেতেন। সেক্ষেত্রে কখনও তাঁরা ‘অনুরূপ’ বা ‘এমনটা’ তিনি বলেছেন, বলে অনিচ্ছাকৃত শব্দগত সামান্য ভুলের পরিণতিও এড়ানোর প্রয়াস পেতেন।)
একবার আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা. অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে দেখতে গেলেন হযরত উসমান রা.। তিনি তাঁকে বললেন, আপনার কী অসুখ? তিনি বললেন, আমার পাপরাশি। উসমান রা. বললেন, আপনার চাহিদা কী? এখন কী খেতে মনে চায়? মনের বাসনা কী? তিনি বললেন, আমার পরওয়ারদেগারের রহমত ও তাঁর সন্তুষ্টি। উসমান রা. বললেন, আপনার জন্য ডাক্তার ডাকবো? তিনি বললেন, ডাক্তারই আমাকে রোগী বানিয়েছে। উসমান রা. বললেন, আপনার জন্য ভাতার ব্যবস্থা করবো? তিনি বললেন, না। দরকার নেই।
আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা. মৃত্যুকালে কাঁদলেন। দু’চোখে পানি বেয়ে পড়ছে। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কেন কাঁদছেন? অথচ আপনি তো রাসূলের সাহাবী। তিনি বললেন, আমি না কেঁদে কীভাবে থাকতে পারি? আমি তো আল্লাহ তাআলার নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত ছিলাম। তাঁর হুকুম অমান্য করেছিলাম। দুনিয়ার জীবন শেষ হয়ে গেছে। আমল ও ক্রিয়াকর্ম মালার ন্যায় মানুষের ঘাড়ে রয়ে গেছে। ভালো তো ভালো। মন্দ হলে তো মন্দ।
হিজরী ৩২ সালে মদীনা মুনাওয়ারায় তিনি মারা যান। জান্নাতুল বাকী গোরস্তানে সমাহিত হন।