আওযায়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৫৭ হিজরী : ৭৭৪ খৃস্টাব্দ)

যাঁর দুনিয়া প্রস্থানে ইলম ও জ্ঞান শোকের কাপড় পরিধান করেছিল। যাঁর কথা সম্রাটদের তরবারি অপেক্ষা ভীতিকর ছিল। আলেমের উপাধি নিয়ে যিনি দুনিয়াবাসীর মাঝে জীবনযাপন করেছিলেন। আকাশবাসীদের মাঝে যিনি শাহাদাতের মর্যাদায় ভূষিত ছিলেন। দুনিয়া সেজেগোছে যাঁর সামনে হাজির হয়েছিল। কিন্তু তিনি দু’চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। দুনিয়া তার কাছে মরীচিকা ও বৃথা আশার ছলনা ছিল। তিনি আব্দুর রহমান ইবনে আমর আলআওযায়ী। আওযা গোত্রের লোক। ফিকহ ও যুহদ বিষয়ে সিরয়ী জনপদের প্রধান ব্যক্তি। সিরিয়ার বা’লাবাক্কু জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই বেড়ে ওঠেন। পরবর্তীতে বৈরুতে ছিলেন।
সময়ের সেরা ব্যক্তিত্ব এবং যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন ছিলেন। আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে নিন্দুকের নিন্দা গ্রাহ্য করতনে না। বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেন। বিশাল মর্যাদাবান ব্যক্তি। বাদশাহ’র চেয়ে অধিক সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। বিদ্যা-বুদ্ধি এবং মর্যাদায় অনেক বড় মাপের আলেম ছিলেন। আমৃত্যু তিনি সীমান্ত প্রহরী বেশে থাকার মানসে বৈরুতে এসে বসবাস শুরু করেন।
ইতিহাসের পাতায় পাতায় তার বিবরণ। কলম ও ইতিহাস থেকে শোনা যাক তার যুহদ-দুনিয়াত্যাগ, চালচলন এবং হাল-হকিকত সম্পর্কিত কিছু বিবরণ। এই তো বিশর ইবনে ওয়ালীদ। তিনিই ইতিহাসের সোনালী অধ্যায় থেকে জানাচ্ছেন। আওযায়ী রহ.কে আমি দেখিছি, মনে হল বিনয়াবনত একজন অন্ধ ব্যক্তি। আব্বাস ইবনুল ওয়ালীদ রহ. হযরত আওযায়ী রহ. এক চরিত্রের বর্ণনা দিচ্ছেন, আওযায়ী রহ. নিজে যেমন পরিশীলিত ও মার্জিত রুচির অধিকারী ছিলেন রাজা-বাদশাহগণ নিজেদেরকে এবং তাদের সন্তান-সন্ততিকে সেভাবে গড়ে তুলতে অক্ষম হয়েছেন।
একদিন একলোক তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, বিনয় কী? তিনি বললেন, ‘দৃষ্টি অবনত রাখা, কাউকে নিজের পক্ষপুটে আশ্রয় দেওয়া এবং হৃদয়ের কোমলতা। মনের কোমলতা বলতে পরকালচিন্তা ও আখেরাতের ডর-ভয়।’ হযরত আওযায়ী রহ. দুনিয়ার প্রতি নির্লিপ্ত ছিলেন। অর্থকড়ি উপার্জনে নিজের হায়াত ব্যয় করেননি। জনশ্রুতি রয়েছে যে, ইমাম আওযায়ী রহ. মারা যাওয়ার সময় মাত্র ছয় দীনার রেখে মারা গিয়েছিলেন। তিনি প্রায় সময় নীরব থাকতেন। নিঃসঙ্গ থাকতে ভালবাসতেন। তিনি বলতেন, (মানসিক ও শারীরিক) প্রশান্তি দশ ভাগ। নয় ভাগ নীরবতায় আর একভাগ লোকজন থেকে দূরে থাকায়।
তার কাছে দু’টি হাতিয়ার ছিল। তাকওয়া এবং বাদশাহ’র নিকট তার গ্রাহ্য কথা। (তিনি যা-ই বলতেন বা সুপারিশ করতেন বাদশাহগণ তার কথা রাখতেন)। একবার এক খ্রিস্টান এক কলসী মধু হাদিয়া নিয়ে ইমাম আওযায়ী এর নিকট হাজির। এসে বলল, আবূ আমর! আমার জন্য বা’লাবাক্কু জেলার প্রশাসকের নিকট সুপারিশ করুন। (তিনি যেন আমার জন্য বরাদ্দ বা হাদিয়া প্রদানে সম্মতি জ্ঞাপন করেন)। ইমাম আওযায়ী রহ. গম্ভীর ও পরিতৃপ্ত অবস্থায় বললেন, নাও তোমার কলসী। আমি তোমার জন্য সুপারিশ করে গভর্নরের নিকট লিখে দিচ্ছি। তার সুপারিশের খাতিরে গভর্নর তার জিজিয়া থেকে ত্রিশ দীনার হ্রাস করে দিলেন।
গণমানুষ ও সৎপরায়ণ লোকেরা হৃদয়ে তার প্রতি বদ্ধমূল ভালোবাসা পোষণ করতো। ইমাম সাওরী রহ. জানতে পারলেন যে, মক্কা শরীফে ইমাম আওযায়ী রহ. আগমন করেছেন। তার সাথে দেখা করার জন্য তিনি বের হলেন। মক্কার অদূরে ‘যি তুয়া’ নামক স্থানে তার সাথে দেখা হয়। এরপর ইমাম সাওরী কাফেলা থেকে নিজের উট আলাদা করে নিলেন। এরপর তিনি ইমাম আওযায়ী রহ. এর সাথেই ছিলেন। কাফেলার সাথে দেখা হলে বলতেন, শাইখের জন্য রাস্তা প্রশস্ত কর।
ইমাম আওযায়ী রহ. এর বৈশিষ্ট্য, ইবাদত, যুহদ ও তাকওয়ার বিশাল ফিরিস্তি রয়েছে। রাত জেগে তিনি নামায পড়তে ভালোবাসতেন। লোকদেরকে উপদেশ দিতেন। তিনি বলেছেন, যে কিয়ামুল রাইল বেশি করবে, রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী বেশি করবে কেয়ামত দিবসে তার জন্য অবস্থান সহজ করে দেওয়া হবে। ইমাম আওযায়ী ফজর পড়ে কারও সাথে কথা বলতেন না। বসে বসে যিকির করতেন। সূর্যোদয় পর্যন্ত তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করতেন।
আবূ জা’ফর মানসূর হযরত আওযায়ী থেকে ওয়ায শোনার আগ্রহ ব্যক্ত করে লোক পাঠালেন। তিনি বাদশাহ’র দরবারে গিয়ে বললেন, আমীরুল মুমিনীন, কী চান? মানসূর বললেন, তোমাদের থেকে কিছু নিতে চাই। ইমাম আওযায়ী রহ. বললেন, আমীরুল মুমিনীন! যে কোন বান্দার কাছে দ্বীনের কোন নসিহত আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আসে সেটা আল্লাহ তাআলার একটি নেয়ামত। যা তিনি তাকে দিয়েছেন। সে যদি তা গ্রহণ করে তার মূল্যায়ন হবে। অন্যথায় সেটা তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হয়ে দাঁড়াবে। এভাবে সে আরও বড় গুনাহগার হবে। আমীরুল মুমিনীন! যে শাসক নিজের প্রজাকুলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে রাত যাপন করে আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন। আমীরুল মুমিনীন! রাজত্ব যদি আগেকার রাজা-বাদশাহদের কাছে গচ্ছিত ও স্থায়ী থাকতো তাহলে আপনি পেতেন না। এই বাদশাহি যেমনিভাবে অন্যদের জন্য স্থায়িত্ব লাভ করেনি আপনার জন্য সেটা স্থায়িত্ব লাভ করবেনা। আমীরুল মুমিনীন! যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের মাধ্যমে ইজ্জত খোঁজে আল্লাহ তাআলা তাকে সমুন্নত করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নাফরমানি করে নিজেকে সম্মানিত করতে চায় তাকে তিনি অপমানিত ও লাঞ্ছিত করবেন। এটাই আমার নসিহত। ওয়াস্সালাম। একথা বলে তিনি উঠে চলে গেলেন।
কথায় কথায় চোখের পানিতে নয়ন ভাসাতেন। কান্নাপ্রবণ ও অশ্রুপ্রবণ ব্যক্তি। খোদাভীতি ও মৃত্যুস্মরণে তার হৃদয় টইটুম্বর ছিল। তার মা তাকে মুসল্লায় কোন্ অবস্থায় আছে তা পর্যবেক্ষণ করতেন। নামায শেষে যখন তিনি বের হতেন তখন তার মা দেখতে পেতেন সিজদার স্থানটি চোখের পানিতে ভিজে গেছে।
একদিন ইমাম আওযায়ী রহ. নিজের সাগরিদ ও শিষ্যদের দেখতে বের হলেন। তাদের মুখম-লের দিকে তাকিয়ে উপদেশস্বরূপ বললেন, মৃত্যুর কথা যে ব্যক্তি স্মরণ করবে তার জন্য সামান্য কিছু যথেষ্ট হবে। হিজরী ১৫৭ সালে সীমান্ত প্রহরী থাকাবস্থায় বৈরুতে তিনি মারা যান। জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল শাহাদাত লাভ করা। শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করতে করতে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it